শেয়ারবাজার: মাসুদ খানের ৫ পরামর্শ

 



যদি আপনি শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের কথা ভাবেন, তাহলে আপনাকে এমন কোম্পানি বাছাই করতে হবে, যা আপনাকে যৌক্তিক রিটার্ন দেবে। এ জন্য বিনিয়োগের আগে কোম্পানি বাছাইয়ে আপনাকে কিছু বিষয় ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। ভালো কোম্পানি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম রয়েছে, যা মেনে চললে আপনার ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কমে যাবে।


আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী গুজবের ওপর ভিত্তি করে শেয়ার কিনে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, গুজব হয়তো সত্যি হবে। শেয়ারবাজারের জন্য গুজব একধরনের ফাঁদ। এ ধরনের ফাঁদে পা না দিয়ে বিনিয়োগের আগে কোম্পানির মৌলভিত্তি যাচাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নিন, যা দীর্ঘ মেয়াদে আপনাকে মুনাফা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।


১. মালিকদের খ্যাতিকে বিবেচনায় নিন

এখানে কোম্পানির মালিক বলতে উদ্যোক্তাদের বোঝানো হয়েছে। এটা জানা খুব জরুরি যে কারা কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠাতাদের হাতে কোম্পানির কী পরিমাণ শেয়ার বা অংশীদারত্ব রয়েছে এবং পরিচালনা পর্ষদ কাদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। সমাজে ও ব্যবসায়িকভাবে কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সুনাম কেমন, সেটি বিবেচনায় নেওয়া খুবই জরুরি। ব্যবসায়ী হিসেবে যাঁদের যথেষ্ট সুনাম আছে, ভালোভাবে ব্যবসা ও কোম্পানি পরিচালনার ইতিহাস রয়েছে, যেসব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন যথেষ্ট স্বচ্ছ এবং সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারের প্রতি যাঁদের সম্মান ও দায়বদ্ধতা রয়েছে, সেসব উদ্যোক্তার কোম্পানিতে বিনিয়োগ অনেক নিরাপদ।


২. ইপিএসের প্রবৃদ্ধির ধারা পর্যালোচনা করুন

শেয়ারবাজারের কোনো কোম্পানির মুনাফা বোঝার জন্য শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ইপিএসের মাধ্যমে কোম্পানির কার্যক্রম সম্পর্কেও একজন বিনিয়োগকারী সম্যক ধারণা পেতে পারেন। তাই কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে ওই কোম্পানির বিগত পাঁচ বছরের ইপিএস পর্যালোচনা করতে হবে। তাতে ইপিএসের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি রয়েছে কি না, তা দেখা জরুরি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সহজেই যেকোনো কোম্পানির ইপিএসের তথ্য পাওয়া যাবে।


৩. মূলধনের বিপরীতে আয়

কোনো কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগ করা অর্থের বিপরীতে কোম্পানিটি কী পরিমাণ নিট মুনাফা করছে, তা বোঝা বা জানা খুব জরুরি। আর সেটি বোঝা যায় কোম্পানির রিটার্ন অন ইক্যুইটি (আরওই) বা মূলধনের বিপরীতে আয় থেকে। শেয়ারহোল্ডারদের টাকা একটি কোম্পানি কতটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আরওইতে। কোনো কোম্পানির ইক্যুইটিতে বিনিয়োগের আগে ওই কোম্পানির আরওই ভালোভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। সাধারণ নিয়ম হলো, কোম্পানির আরওই অবশ্যই মূলধনের চেয়ে বেশি হতে হবে। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা কোনো কোম্পানির ইক্যুইটি বিনিয়োগ করলে তার বিপরীতে বছর শেষে ন্যূনতম ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ রিটার্ন বা মুনাফা না পেলে ওই বিনিয়োগ লাভজনক হয় না। তাই মূলধনের তুলনায় কোনো কোম্পানির আরওই যদি ১৮ শতাংশ বা তার বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে কোম্পানিটির ব্যবসা ভালো চলছে। 


দীর্ঘ সময় ধরে একটি কোম্পানির আরওই বেশি হওয়া মানে ওই কোম্পানির বাজার প্রতিযোগিতায় ভালোভাবে টিকে থাকার কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে, অন্যান্য প্রতিযোগীর তুলনায় ওই কোম্পানিকে এগিয়ে রেখেছে। 


যেকোনো কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে সহজে আরওই সংক্রান্ত তথ্য বের করা সম্ভব। বার্ষিক প্রতিবেদনের আয় বিবৃতিতে (ইনকাম স্টেটমেন্ট) ওই কোম্পানির প্রকৃত মুনাফার তথ্য পাওয়া যায়। আর শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগকৃত অর্থের হিসাব থাকে আর্থিক বিবরণীতে। তালিকাভুক্ত ভালো কোম্পানিগুলো তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে আলাদাভাবে আরওই অনুপাত প্রকাশ করে থাকে। 


৪. মূলধনের তুলনায় ঋণ কম

বাংলাদেশের বেশির ভাগ কোম্পানিরই বিপুল পরিমাণ ঋণ থাকে। যেসব ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বেশি এবং মুনাফার হার কম, সেসব ব্যবসার ক্ষেত্রে বিপুল ঋণ কোম্পানির জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। কারণ, ঋণের সুদ কোম্পানির মুনাফা কমিয়ে দেয় এমনকি কোম্পানিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানও বানিয়ে ফেলতে পারে। 


তাই মূলধনের বিপরীতে ঋণ কম এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করাই ভালো। কোনো কোম্পানির ঋণ যদি মূলধনের ১ শতাংশের মধ্যে থাকে, সেটি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু মূলধনের দেড় শতাংশের বেশি ঋণ আছে এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই ভালো। বার্ষিক প্রতিবেদনের আর্থিক বিবৃতিতে দায় অংশে ওই কোম্পানির ঋণের তথ্য থাকে।


৫. যুক্তিসংগত দামে শেয়ার কিনুন

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ভালো কোম্পানি বাছাই করার কাজটি সহজ নয়। যদিও ওপরে ভালো কোম্পানি খুঁজে বের করার কিছু উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে। সেসব বিষয় মিলিয়ে দেখার পাশাপাশি একজন বিনিয়োগকারীকে এটাও নিশ্চিত হতে হবে, ভালো শেয়ার তিনি বেশি দামে কিনছেন কি না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। শেয়ারের বাজারমূল্যকে ইপিএস দিয়ে ভাগ করে এ পিই রেশিও বের করা হয়। ধরা যাক, কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ১২। তার মানে হলো, ওই কোম্পানির বর্তমান ইপিএসের ধারা অব্যাহত থাকলে একজন বিনিয়োগকারী ১২ বছরে তার বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাবেন। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, যেসব কোম্পানির পিই রেশিও ২৫-এর বেশি, সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই ভালো। 


মাসুদ খান: চেয়ারম্যান, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন ও প্রধান উপদেষ্টা, ক্রাউন সিমেন্ট


Post a Comment

Previous Post Next Post