কিভাবে নিষ্ক্রিয় গ্যাসবর্গের কূঁড়েমি ভাঙল

 'দুটি সমান্তরাল রেখা কখনই পরস্পরকে ছেদ করে না!' কথাটি প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠতম গানিতবিদ ইউক্লিডের মুখনিঃসৃত এবং শুধু এজন্যই প্রত্যয়টি জ্যামিতির কাছে অভ্রান্ত।


'মোটেই তা নয়, তারা পরস্পরকে ছেদ করতে বাধ্য!' ঘোষণা করলেন রুশ বিজ্ঞানী নিকোলাই লবাচেভস্কি গত শতকের মাঝামাঝি। আর এভাবেই জন্মিল এক নতুন অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি।


'যত সব ফাঁকিবাজি আর আজেবাজে বক বকানি!' শুরুতে বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা এটা বলে তাদের মত প্রকাশ করলেন।


অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি ছাড়া কিই  বা করার ছিল? তখনও আপেক্ষিকতাবাদ অথবা মহাজগতের গড়ন সম্পর্কে দুঃসাহসী প্রত্যয়াদি মানুষের অজানা। 


আপনারা অনেকেই আলেক্সেই তলস্তয়ের 'ইঞ্জিনিয় গারিনের পরাবৃত্ত'  হয়ত পড়েছেন। সারা দুনিয়াতে সাহিত্য সমালোচকদের রায়: 'এক অনব্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী'। 'গল্পটি কিন্তু মোটেই সত্য হয়ে উঠবেনা!' বিজ্ঞানীরা এমন প্রতিধ্বনি করেছিলেন।


কিন্তু আলেক্সেই তলস্তয় মরার মাত্র পনের বছর পরই চুনি-কেলাসে অশ্রুতপূর্ব উজ্জলতা ও শক্তিধর এক আলোকরশ্মি আবিষ্কৃত হল আর 'লেজার' শব্দটি বিশেষজ্ঞদের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণেও ছড়িয়ে পরল। অতুৎসাহী রাসায়নিক তখনও নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলির অতলান্তিক একগুয়েমি ভাঙার আসা ছারে নি।


আমরা যদি বিশ, ত্রিশ ও চল্লিশ দশকের বিজ্ঞান সাময়িকীর বিবর্ণ পাতা উল্টিয়ে যাই তবে বহু কৌতুকপ্রদ নিবন্ধন ও টীকায় নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলিকে সক্রিয় কর্মকান্ডে লিপ্তকরনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে রাসায়নিক দের দুর্মর প্রত্যাশার বিস্তর প্রমাণ খুঁজে পাব। ঐ পাতাগুলো থেকে অদ্ভুত সূত্রাবলি আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরা আমাদের বহু অজানা পদার্থের কথা বলে: পারদ, প্যয়লভিয়াম, প্লাটিনাম ও অন্যান্য ধাতুর সাথে সংশ্লেষিত হিলিয়ামের যৌগ।

এখানে সামান্য ভুলের অবকাশ রয়েছে: কথিত রাসায়নিক যৌগগুলো প্রাপ্তিযোগ্য পদার্থ নয়। ওদের মধ্য হিলিয়ামের দুই ইলেকট্রন খোলকটি পুরোপুরি অটুট আর যৌগ গুলি আস্ত থাকে এবং তা অতি নিম্ন তাপমাত্রায়, শূন্য ডিগ্রীর দেশে।


বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোর পাতায় আরও একটু সংবাদ পাব। সেভিয়েত রাসায়নিক নিকিতিন অপেক্ষাকৃত স্বল্প বিস্ময়কর দুটি যৌগ তৈরি করেছিলেন। ওগুলো জেনন ও রেডনের সঙ্গে জল কার্বলিক এসিড ও আরও কয়েকটি যৈব দ্রবণের যৌগ : Xe.6H2O এবং Rn.6H2O। এরা সাধারন অবস্থায় ও সুস্থিত থাকে, সহজে পাওয়া যায় কিন্তু...

কিন্তু আগের মত এখনও যৌগগুলির রাসায়নিক বন্ধনের কোন ব্যাবধানই ছিলোনা। জেনন ও রেডন পরমাণু প্রত্যন্ত খোলকের নিটোল সম্পূর্ণতার বদৌলতে দিব্যি টিকে রইল: যে ৮টি ইলেকট্রন প্রথমে ছিল সেই ৮টি ইলেকট্রন শেষে থাকল।


নিষ্ক্রিয় গ্যাসবর্গ আবিষ্কারের পর অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেল, কিন্তু ঠেলাগাড়ি একটুও নড়ল না।


বিংশ শতাব্দী, মানব ইতিহাসের সর্বাধিক ঝঞ্ঝক্ষুব্ধ ও অবিস্মরনীয় এই শতাব্দীটির অন্তিম পর্যায় আজ আসন্ন। বিজ্ঞানীরা বিগত শতবর্ষের বৈজ্ঞানিক সাফল্যের হিসেব-নিকেশ হয়ত শুরু করবেন। উল্লেখ্য আবিষ্কার সমূহের সেই দীর্ঘ তালিকার এক বিশিষ্ট স্থানে থাকবে 'নিষ্ক্রিয় গ্যাসের যৌগ উৎপাদন'। আর অতুৎসাহী ভাষ্যকাররা এতে যোগ করবেন: সর্বাধিক রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের অন্যতম।


রোমাঞ্চকর? দৈবাৎ! বরোজোর কোনো রোমান্টিক কাহীনি অথবা বহু বছর যে দুরূহ সমস্যায় বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন তার আকস্মিক সহজ সমাধান।


আমাদের কালের রসায়ন যেন এক মহীরুহ, যার বিশাল শীর্ষের শাখাপ্রশাখা বারবাড়ন্ত অশেষ। এর কোন একটি শাখা একক প্রচেষ্টায় পুরোপুরি আয়ত্ত করা এখন দুরূহ। একটি শাখাখান্ত, একটি কুড়ি কিংবা অদৃশ্যপ্রায় কোন মুকুলের সঙ্গে যথাযথ ভাবে পরিচিত হতেই একজন গবেষকদের বহু  বছর কেটে যাবে। এমন হাজার হাজার গবেষণার ফলেই গড়ে উঠে এর পুরো একটা শাখা। কানাডার রসায়নবিদ নিল বার্টলেট এমনি একটি কুড়ি নিয়ে কাজ করেছিলেন। রাসায়নিক পরিভাষায় তার উপকরণ টির নাম প্ল্যাটিনাম হেক্সফ্লোরিড এবং এর সংকেত : PtF6। নেহাৎ আপতিক কোনো ঘটনাচক্রে এজন্য তিনি তার সময় ও শক্তি ব্যয় করেননি। ভারি ধাতুলগ্ন ফ্লোরিন-যৌগ অত্যাকর্ষী বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নিউক্লিয় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ - ইউরেনিয়াম-২৩৫ ও ইউরেনিয়াম-২৩৮ পৃথকীকরণে এগুলি ব্যবহৃত হয়। আইসোটোপের একটিকে অন্যটি হতে আলাদা করা বেশ জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরিড UF6- এর সাহায্য তা সম্ভবপর। তা ছাড়া,  ভারি ধাতুলগ্ন ফ্লোরিন রাসায়নিক পদার্থ হিসেবেও অত্যন্ত সক্রিয়। বার্টলেট PtF6 ও অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে এক আশ্চর্য যৌগ পেলেন। যেখানে অক্সিজেন আটকা পরল এক ধনাত্মক আধানধর O2 অনু হিসাবে। আসলে অনুটি একটা ইলেকট্রন হারিয়ে ছিল। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ঘটনাটির মূল বৈশিষ্ট্য অক্সিজেন অনুর ইলেকট্রনচুত্যি, কারন কাজটি দূাসাধ্যপ্রায় আর এতে প্রয়োজন অঢেল শক্তি খরচা। দেখা গেল, প্লাটিনাম হেক্সাফ্লোরিড সেই অঘটন - পটীয়সী, যে অক্সিজেনের একটি ইলেকট্রন খসাতে সমর্থ। 


বস্তত, নিষ্ক্রিয় গ্যাসবর্গের প্রান্ত খোলক থেকে ইলেকট্রন অপসারণেও প্রচুর শক্তিব্যয় অপরিহার্য। এখানেও একটি শৃঙ্খলা আছে: নিষ্ক্রিয় গ্যাসটি যত ভারি প্রয়োজনীয় শক্তিও তত কম। দেখা গেল অক্সিজেন অনুর একটি ইলেকট্রন খসানোর চেয়ে জেনন অনুর সরানো সহজ তর। তা যদি হয়, এখানেই সবচেয়ে আকর্ষীর শুরু! হেক্সাফ্লোরিন প্লাটিনামকে জেননের ইলেকট্রন অপসারনির ভূমিকা নিতে বাধ্য করাতে বার্টলেট ঠিক করলেন এবং তিনি সফল হলেন। ১৯৬২ সালে পৃথিবীতে প্রথম জন্মিল নিষ্ক্রিয় গ্যাসের যৌগ। যার নাম অনেকটা এরকম : XePtF6। আর সেটা যথেষ্ট সুস্থিত।


অদৃশ্যপ্রায় এই শস্যকণাটি অচিরেই অঙ্কুরিত হল। অঙ্কুরটি বাশের মত দ্রুত গজিয়ে উঠল, জন্মিল এক নতুন রসায়ন শাখা: নিষ্ক্রিয় গ্যাসের রসায়ন। সেদিনও অনেক বিজ্ঞানী বিষয়টি সম্পর্কে অত্যন্ত সংশয়ী ছিলেন। আজ তাদের হাতে আছে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের প্রায় ৫০ টি সত্যিকার রাসায়নিক যৌগ, প্রধানত জেনন, কিপ্টন, রেডন, ফ্লোরাইড ও অক্সাইড। 

সুতরাং অভিজাত গ্যাসবর্গের প্রত্যন্ত ইলেকট্রন খোলকের অভেদ্যতা অবশেষে বিধ্বস্ত হল!


কিন্তু নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলির যৌগসমুহের আণবিক সংযুতি? বিজ্ঞানীরা সবে মাত্র তা সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন। জানা গেছে, পরমাণুতে যে যোজ্যতাশক্তি সরবরাহে সমর্থ তার পরিমান সম্পর্কে আমাদের পূর্বজ্ঞান ভ্রান্ত ছিল; তাদের এ ক্ষমতা আরও অনেক বেশি।


আগে যোজ্যতা প্রত্যয়ের ভিত্তি ৮-ইলেকট্রন খোলকের বিশেষ সুস্থিতি ও অব্যর্থতার স্বীকৃতিতে নিহত ছিল। এখন বিজ্ঞানীরা উক্ত তত্তাবলীর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। সমম্ভবত তা আপনাদের ভাগ্যের অনুকূল হবে, সহায়ক হবে স্বকীয় নতুন নিয়মাবলী উন্মোচনে..........



তথ্যসংগ্রহ : 

  • লেভ ভ্লাসভ – দমিত্রিই ত্রিফোনভ এর রসায়নের শতগল্প

Post a Comment

Previous Post Next Post