একেক দেশে একেক সময়ে একেক প্রাণী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। যেমন বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে মশা। কারণ আর কিছু না, চিকুনগুনিয়া। তার আগে নিপা ভাইরাস ছড়িয়ে আলোচনায় এসেছিল বাদুড়,তার আগে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে গরু-মোষ-ছাগল ভেড়া। মশা প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়ে মানব জাতিকে বিরক্ত কিংবা রোগগ্রস্ত করতে প্রাগৈতিহাস কাল থেকে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেই মশারই আজ সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করব।
মশা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। আবার সব জায়গায় সব প্রজাতি পাওয়া যায় না। ভারতীয় উপমহাদেশে রোগ ছড়ানো প্রধান চারটি মশার গণ হল : Anopheles, Culex, Aedes, Mansonia. মশার শরীর তিনটি অংশে বিভক্ত: মস্তিষ্ক,বক্ষ, উদর।
মস্তিষ্ক: এটি দেখতে অনেকটা গোলাকার। এতে আছে
১) একজোড়া বড় চোখ
২) প্রবসিস: এটা একটা লম্বা সুইয়ের মত গঠন। প্রবসিস দিয়েই মশা কামড়ায়।
৩) এক জোড়া পালপি। প্রবসিসের পাশে একটা করে অবস্থিত
৪) এন্টেনা বা ফিলার : এক জোড়া। পুরুষ মশায় এটা আশালো (bushy) হলেও স্ত্রী মশায় তা নয়। এন্টেনা দেখে সহজেই মশার লিঙ্গ নির্ণয় করা যায়।
বক্ষ: বক্ষ আকারে তুলনামূলকভাবে বড় এবং গোলাকার। এতে আছে-
১) ডানা: এক জোড়া
২) পা: তিনজোড়া
উদর: লম্বা এবং দশটি খন্ডাংশে বিভক্ত। শেষের দুই খন্ড মডিফাইড হয়ে মশার বহিঃজননাঙ্গ গঠন করে।
জীবনচক্র: মশার জীবনচক্রে চারটি ধাপ আছে। যথা : ডিম, লার্ভা, পিউপা, প্রাপ্ত বয়স্ক মশা। মশার জীবনচক্রে মেটামরফোসিস সম্পূর্ণ।
ডিম: মশা পানির উপরিতলে একবারে ১০০-২৫০ টি করে ডিম পাড়ে। Anopheles মশা পৃথক পৃথকভাবে ডিম পারে। ডিমগুলোর আকার অনেকটা নৌকার মত Culex ডিম পাড়ে ছোট ছোট গুচ্ছ করে। Aedes পৃথক পৃথকভাবে সিগার আকৃতির ডিম পাড়ে। আর Mansonia জলজ উদ্ভিদ বিশেষ করে pistia -এর পাতার নিচে তারাকাকৃতির গুচ্ছ করে ডিম পাড়ে। রক্ত চোষার পর থেকে ডিম পাড়া পর্যন্ত সময়টাকে গনোট্রফিক চক্র (gonotrophic cycle) বলে। উষ্ণ-আদ্র ট্রপিকাল অঞ্চলে সময়টা প্রায় ৪৮ ঘন্টা।
লার্ভা: ডিম ১-২ দিনের মধ্যে লার্ভায় পরিণত হয়। লার্ভা পানিতে মুক্তভাবে সাঁতার কাটে। এর দেহ লম্বা এবং একে মস্তিষ্ক, বক্ষ, উদরে ভাগ করা যায়। লার্ভারা খাবার গ্রহণ করে। এদের খাবারের তালিকায় আছে শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া, প্লাক্টন ইত্যাদি। লার্ভা দেখেও বলা যায় এটা কোন ধরণের মশার। Anopheles মশার লার্ভা পানির উপরি তলের সাথে সমান্তরাল ভাবে ভেসে থাকে এবং এর কোনো সাইফন টিউব থাকে না। বাকি তিন ধরণের (Culex, Aedes, Mansonia) মশার লার্ভা মাথা নিচের দিকে দেয়ে ভাসে এবং তাদের অষ্টম উদরীয় খন্ডাংশে সাইফন টিউব থাকে। Mansonia -র লার্ভা একটা অদ্ভুদ কাজ করে। এরা জলজ উদ্ভিদের ছোট শেকড়ের সাথে তাদের সাইফন টিউব দ্বারা লেগে থাকে। লার্ভা দশা ৫-৭ দিন স্হায়ী হয়।
পিউপা: পিউপা দেখতে অনেকটা কমার (,) মত। এর বক্ষ থেকো দুটো শ্বসন নল বের হয়। মশার জীবনচক্রের বিশ্রামের দশা হল পিউপা। এসময় এরা কিছু খায় না। পানির উপরিতলে নিশ্চল অবস্হায় থাকতে পছন্দ করে। তবে বিরক্ত করলে দ্রুত গভঢর পানিতে ডুব দেয়। পিউপা দশা ১-২ দিন স্জায়ী হয়।
পূর্নবয়স্ক মশা: গঠন সম্পূর্ণ হওয়ার পিউপার আবরণ পেছন দিক থেকে ফেটে যায় এবং পূর্নাঙ্গ মশা বের হয়ে আসে। এটা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এসময়ে এর ডানা মেলে এবং ডানা শক্ত হয়। তারপর উড়াউড়ি শুরু করে। উপযুক্ত পরিবেশ এবং খাবার থাকলে ডিম থেকে পূর্নাঙ্গ মশায় পরিনত হতে ৭-১০ দিন সময় লাগে। সাধারণ পুর্নাঙ্গ মশা প্রায় ২ সপ্তাহ বাঁচে। তবে পুরুষ মশার আয়ুষ্কাল স্ত্রী মশার চেয়ে কম!
এবার চার ধরণের মশার সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
Anopheles: ম্যালেরিয়া ছড়ানোর জন্য বিখ্যাত। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৪৫ প্রজাতির Anopheles মশার দেখে মেলে। তবে সবাই ম্যালেরিয়ার ভেক্টর না। যারা ছড়ায় তারা হল Anopheles culicifacies, Anopheles fluviatilis, Anopheles minimus, Anopheles philippinensis, Anopheles stephensi, Anopheles sundaicus এবং Anopheles leucosphyrus. তবে সবাই সব এলাকায় থাকে না। কেউ শহুরে, কেউ গেঁয়ো, কেউ জংলী, কেউবা পাহাড়ী, কেউবা ভালোবাসে সমুদ্রের তীর। Abopheles fluiatilis আর Anopheles minimus থাকে পাহাড়ী অঞ্চলে, Anopheles sundaicus আর Anopheles stephensi থাকে উপকূলীয় অঞ্চলে, Anopheles culicifacies আর Anopheles philippinensis বাস করে সমভূমিতে।
Culex: মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিরক্তকারী মশা হল কিউলেক্স।এরা আমাদের রাতের ঘুমে ডিস্টার্ব করে, সন্ধ্যায় পড়তে দেয় না। এর একটি প্রজাতি Culex fatigans গোদ রোগ ছড়ায়। নগরায়নের কারণে বদ্ধ ময়লা-নোংরা পানি বাড়ার সাথে সাথে Culex মশা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
Aedes: এ মশাকে সহজেই এর গায়ের সাদা সাদা দাগ দেখে সনাক্ত করা যায়। একে "টাইগার মশা"ও বলা হয়। এ গ্রুপের উল্লেখযোগ্য মশারা হল Aedes aegipti, Aedes vittatus ও Aedes albopictus. এ মশা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বর্ষাকালে। Aedes মশা ইয়োলো ফিভার, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ছড়ায়। এরা যেহেতু পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে ডিম পারে তাই এদের দমনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কোথাও যেন এদের প্রজননোপযোগী পানি জমতে না পারে সেদিকে নজর দেয়া।
Mansonia: এ গণের মশারা বড়, রং কালো বা বাদামী এবং এদের ডানা ও পায়ে ফুটকি থাকে। সবচেয়ে বেশি দেখা যাওয়া প্রজাতিগুলো হল M. annulifera, M. uniformis, M. indiana এবং M.longipalpis. এরা যেহেতু এরা বিশেষ ধরণের জলজ উদ্ভিদ পরিপূর্ণ জলাশয়ে ডিম পাড়ে তাই জলজ আগাছা পরিষ্কার করে সহজেই এদের দমন করা যায়।
মশা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন কানুন: WHO এর International Health Regulation(IHR) অনুযায়ী সকল বিমানবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরকে মশামুক্ত রাখা হয়। বন্দরের ৪০০ মিটারের মধ্যে মশার উপস্হিতি সহ্য করা হয় না।
মশার অভ্যাস:
১) খাওয়া-দাওয়া: পুরুষ মশা কখনো কামড়ায় না। তারা গাছের রস খেয়ে বাঁচে। অপরদিকে স্ত্রী মশারা রক্ত খায় কারণ মশার ডিমের বৃদ্ধির জন্য রক্ত দরকার। তবে বিভিন্ন প্রজাতির মশার রক্তের চাহিদা বিভিন্ন ধরণের। কেউ মানুষের রক্ত পছন্দ করে, কেউ অন্যান্য পশুর রক্ত পছন্দ করে আবার অনেকে পছন্দ করে দুটোই।
২)কামড়ানোর সময়: একেক প্রজাতিতে একেক রকম যেমন Culex কামড়ায় সন্ধ্যায় ও রাতে, Aedes দিনে।
৩) বিশ্রামের ধরণ: মশারা দিনের বেলায় সাধারণত নিজেদের ঠান্ঠা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখে।
৪) প্রজনন: পানিতে ডিম পাড়ে। Anopheles পছন্দ করে পরিষ্কার পানি, Culex পছন্দ করে ময়লা পানি, Aedes পছন্দ করে কৃত্রিমভাবে জমা হওয়া পরিষ্কার বদ্ধ পানি আর Mansonia পছন্দ করে বিশেষ ধরণের জলজ উদ্ভিদ পরিপূর্ণ জলাশয়।
৫) শীতনিদ্রা: যখন শীত চলে আসে তখন প্রাপ্তবয়স্ক মশারা শীতনিদ্রায় চলে যায়।
৬)বিচরণ এলাকা: মশারা জন্মস্হল থেকে বেশি দূরে যায় না। তবে বায়ু প্রবাহ তাদের অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে।তারা জন্মস্হান থেকে ১১ কি.মি পর্যন্ত বিচরণ করে থাকে।