কক্সবাজার খুরুশকুলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষে ফেরার পথে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত কক্সবাজার সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল উদ্দিনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুরো জেলাজুড়ে ক্ষোভের ঝড় উঠেছে। চোখের সামনেই ফয়সালকে হত্যার পরিকল্পনা করা হলেও পুলিশ কিংবা দলীয় নেতারা কেউ তাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ তুলে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কড়া সমালোচনা করেছেন।
পাশাপাশি ফয়সালের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে দফায় দফায় মিছিল, সমাবেশ, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতাকর্মীরা। সব মিলিয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল উদ্দিনের হত্যাকাণ্ড কেউ মেনে নিতে পারছে না।
কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুর তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ফয়সালা তোর মৃত্যুতে আমরা সবাই অপরাধী হয়ে গেলাম। তুই জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলি আমরা কত অসহায়। জেনেশুনে সবাই তোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে! তোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার সাহস কোনো নেতা দেখাতে পারল না!! এই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া যায় না।
টেকনাফ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন- ফয়সালের মৃত্যুর জন্য দায়ী শুধু প্রশাসন নয়। আওয়ামী লীগ নেতারাও দায়ী। সম্মেলনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ হোছাইন তানিম মিছিল পরবর্তী পথসভায় বক্তব্যে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ফয়সালের আকুতি তুলে ধরেছেন। তানিমের মতে, ফয়সাল যখন সন্ত্রাসীদের কাছে অবরুদ্ধ ছিল তখন দায়িত্বরত এসআই রায়হানকে বলেছিল, স্যার প্লিজ প্রয়োজনে আমার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে এখান থেকে নিয়ে যান। আর আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- লিডার আমাকে আপনাদের গাড়িতে করে কক্সবাজার পর্যন্ত নিয়ে যান। না হয় ওরা আমাকে মেরে ফেলবে! প্রায় দুই ঘণ্টা ফয়সাল তাদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলী আহমদ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন- আমরা আওয়ামী লীগ পরিবার আজ চরম অসহায়। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। প্রশাসন কোনোভাবে আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকদের পাত্তা দিতে চায় না। অপরদিকে আমাদের দলের কিছু ধান্ধাবাজ নেতারা অল্পতেই বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করে। এভাবে চলছি আমরা।
এদিকে সম্মেলনে থাকা কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক মাহমুদুল করিম মাদু বলেন, সম্মেলন শেষ করে সবাই যার যার গন্তব্যে ফিরছিলেন। এ সময় সন্ত্রাসী আজিজ সিকদার ও জহিরের নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারীরা ছাত্রলীগ নেতা ফয়সালকে মারধর করে। একপর্যায়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসিকে ফোন করা হলে ওসি তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে এসআই রায়হানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পাঠায়। এ সময় হামলার শিকার ছাত্রলীগ নেতাকে সন্ত্রাসীরা পুনরায় হামলা চালানোর চেষ্টা চালায়। সন্ত্রাসীদের এমন আচরণ দেখে আমিসহ (মাদু) আওয়ামী লীগ নেতারা ফয়সালকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু দায়িত্বরত এসআই রায়হান কোনো মতেই রাজি হননি। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতা ফয়সালকে সিএনজি গাড়িতে (অটোরিকশা) উঠিয়ে দেয় পুলিশ। পরে পুলিশ তার পেছনে পেছনে যাওয়ার কথা থাকলেও যথাসময়ে না যাওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে গতিরোধ করে গাড়ি ভাংচুর ও এলোপাথাড়ি কুপিয়ে এবং গুলি করে পালিয়ে যায়।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল হক মুকুল জানান, আমারা সম্মেলন শেষ করে শহরে ফেরার পথে কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ নেতা ফয়সালকে টার্গেট করে হামলার চেষ্টা চালায়। এ সময় থানায় ফোন করে ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের কাছে ফয়সালকে দিয়ে আমরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করি। কিন্তু এসআই তার গাড়িতে ফয়সালকে স্থান দেয়নি। যে কারণে ফয়সাল পুনরায় হামলার শিকার হয়।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান জানান, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পুলিশের চরম গাফিলতি রয়েছে। যারা ওই সময় দায়িত্বে ছিল তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় ছাত্রলীগ কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে।
এদিকে পুলিশের গাফিলতির কারণে ফয়সালের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
পরে কক্সবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মুনীরুল গীয়াসের সরকারি নম্বরে ফোন করা হলে ফোনটি রিসিভ করেন পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সেলিম উদ্দিন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশের গাড়িতে ছাত্রলীগ নেতা ফয়সালকে ওঠানোর জন্য অনুরোধ করেছিল তা সত্য। কিন্তু ওই মুহূর্তে তাদের একটি সিএনজি (অটোরিকশা) ছিল। তাই ওটাকে সামনে দিয়ে ফয়সালকে নিয়ে আসা হচ্ছিল। ওই সময় সন্ত্রাসীরা হামলা করে এবং এ হামলায় পুলিশের গাড়িও ভাংচুর করা হয়। তাছাড়া পুলিশও আহত হয়।
পরিদর্শক (তদন্ত) বলেন, এরপরও যদি দায়িত্বরত অফিসারের কোনো দায়িত্বে অবহেলা থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই নারীসহ ছয়জন আটক হয়েছেন। তবে সরাসরি ঘটনার সঙ্গে কেউ জড়িত আছে কিনা তা প্রতিবেদককে পরিষ্কার করতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
এসআই আবু রায়হান বলেন, ফয়সালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের জিপটি ছিল খোলা থাকায় নিরাপদ মনে হয়নি। এ কারণে তাকে একটি সিএনজিতে তুলে দিয়ে পিছন পিছন যাচ্ছিলাম। হঠাৎই ওই সিএনজিতে হামলায় চালিয়ে ফয়সালকে কুপিয়ে সন্ত্রাসীরা চলে যায়। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।