ডা. সাবিরার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার: ২৪ ঘণ্টা পরও মামলা হয়নি

 

রাজধানীর কলাবাগানের ফার্স্ট লেনের ৫০/১ ভাড়া বাসা থেকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপির (৪৭) রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও মামলা হয়নি।


মঙ্গলবার দুপুর ২ টায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় যোগাযোগ করা হলে পুলিশ জানায়, মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হলেও নিহতের পরিবারের কেউ এখনও মামলা করতে আসেননি।


থানার ডিউটি অফিসার সাব ইন্সপেক্টর সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এখনও মামলা হয়নি।  বাদীর পরিবারের কেউ থানায় আসেনি।


নিউ মার্কেট-কলাবাগান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান জানান, নিহতের পরিবার বাদী হয়ে মামলা করবে।  তবে এখন পর্যন্ত পরিবারের কেউ থানায় মামলা করতে আসেননি।


চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি হত্যার শিকার হয়েছেন ধরেই তদন্ত করছে রমনা বিভাগ পুলিশ ও রমনা গোয়েন্দা পুলিশ।


নিহতের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ছয়-সাত জনকে হেফাজতে নিয়েছে ডিবি পুলিশ।


সোমবার দুপুরে কলাবাগানের ৫০/১ ফাস্ট লেনের বাসার তৃতীয়তলার ভাড়া বাসা থেকে ডা. সাবিরা রহমান লিপির (৪৭) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার পিঠে ও গলায় জখমের চিহ্ন রয়েছে।  


পুলিশের ধারণা, তাকে (সাবিরা) হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।  পরে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।


এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।  সাবিরা গ্রিন রোডের গ্রিনলাইফ হাসপাতালের রেডিওলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।


স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নারী চিকিৎসকের কক্ষে ধোঁয়া দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া হয়।  কিন্তু ভেতর থেকে তালাবদ্ধ থাকায় কক্ষ খোলা যাচ্ছিল না।


এ সময় বাইরে থেকে আসা একই ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দা কানিজ সুবর্ণার কাছে থাকা চাবি নিয়ে পরে ফ্ল্যাটের প্রধান ফটক খোলা হয়। এরপর ডাক্তার সাবিরা রহমান লিপির রুম ভেতর থেকে বন্ধ পেয়ে দরজা ভাঙা হয়।


এ সময় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন কক্ষের ভেতরে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখা যায় সাবিরাকে।


পুলিশ জানায়, সাবিরার শরীরের পেছনের দিকে ধারালো অস্ত্রের গভীর আঘাত রয়েছে। সম্ভবত ধারালো অস্ত্রের আঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতেই আগুনের নাটক সাজানো হয়।


এ ঘটনা তদন্তের স্বার্থে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাবলেটের বাসিন্দা কানিজ সুবর্ণা, তার এক ছেলে বন্ধু, বাড়ির কেয়ারটেকার রমজানসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।


নিহত সাবিরা আলাদা বাসায় থাকতেন।  তার স্বামী থাকেন শান্তিনগরের বাসায়।  প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর এটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিল সাবিরার।


ঘটনাস্থলে থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি, সিআইডি, পিবিআই ও র‌্যাব সদস্যদের দেখা যায়। তারা আলামত সংগ্রহ করছিলেন। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে আলামত সংগ্রহ করতে দেখা যায়।


ঘটনাস্থলে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, তার (সাবিরা) পিঠে, কোমরের ওপরে এবং গলায় গভীর জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আঘাত করা হয়েছে পেছন দিক থেকে।


হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তিনি (সাবিরা) যে বিছানায় শোয়া ছিলেন সেই বিছানার জাজিমে আগুন দেওয়া হয়।


ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেনশাহ মাহমুদ জানান, চিকিৎসকের পিঠে ও গলায় জখমের চিহ্ন আছে। লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।


এ ঘটনায় তার বাসায় সাবলেট থাকা এক মেয়ে, তার বন্ধু এবং বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।


ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে দেখা যায়, সেখানে তিনটি রুম আছে। রুমগুলোর উপরে কাগজে ১, ২, ৩ এভাবে নম্বর লেখা আছে। এক নম্বর রুমে থাকতেন নিহত চিকিৎসক।


তার আত্মীয় পরিচয় দেওয়া কবির হোসেন নামে একজন জানান, চিকিৎসক ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন বলে জানতেন। স্বামী থাকতেন শান্তিনগর এলাকায়। স্বামী ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরি করে অবসরে গেছেন। তার ২১ বছর বয়সি এক ছেলে এবং ১০ বছর বয়সি মেয়ে রয়েছে।


ছেলে-মেয়ে নানির বাসায় থাকে। বাড়ির মালিক মাহবুব জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি তিনি বাসাটি ভাড়া দেন। ওই চিকিৎসক যে সাবলেট হিসাবে কাউকে রেখেছেন তা তিনি জানতেন না। গত পাঁচ মাসে চিকিৎসকের স্বামীকে বাসায় আসতে দেখেননি।


ছেলে-মেয়েরা খুবই কম আসত। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় স্বামী বিদেশে আছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। ভোটার আইডি কার্ডের যে ফটোকপি দেওয়া হয়েছে তা থেকে দেখা যায়, সেখানে চিকিৎসকের নাম লেখা রয়েছে কাজী সাবিরা রহমান, বাবার নাম কাজী ওয়াহিদুর রহমান, স্বামীর নাম একেএম শামসুদ্দিন আজাদ। যেই ছাত্রী সাবলেটে থাকত সে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।


বাড়িওয়ালা বলেন, আগুনের ধোঁয়া দেখে দারোয়ান গিয়ে দরজা বন্ধ পায়। বিষয়টি আমাকে জানালে তখনই আমি সার্কিট ব্রেকার অফ করতে বলি। এরপর দরজা খোলা যাচ্ছিল না। পরে সাবলেটে থাকা মেয়েটি আসার পর মূল দরজা খোলা গেছে।


এ সময় ভেতরে অন্য কেউ ছিল না। তার কক্ষের লক ভেঙে ঢোকা হয়। তিনি আরও বলেন, বাসায় শর্টসার্কিটের কোনো আলামত দেখা যায়নি। কীভাবে আগুন লেগেছে তা বুঝতে পারছি না। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকা হয় এবং পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।


ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক শেখ রাসেল কবির জানান, তার (সাবিরা) গলায় এবং ঘাড়ে দুটি বড় ক্ষত রয়েছে। তাকে স্টেপ করা হয়েছে। পিঠেও দুটি বড় স্টেপ ছিল। হত্যা নিশ্চিত করার পর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।


নিহতের মামাতো ভাই পরিচয় দেওয়া রেজাউল জানান, বর্তমান স্বামীর সঙ্গে তার বনিবনা ছিল না। 


ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক যুগান্তরকে বলেন, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post