রাজধানীর পল্লবীতে চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দিন হত্যায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সুমন বাহিনীর প্রধান সুমন ব্যাপারী। সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
এরপর আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এদিকে সুমন স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হওয়ার পরপরই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয় মামলার বাদী, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনদের।
এদিন ডিবি কার্যালয়ে যান নিহত সাহিনুদ্দিনের স্ত্রী মাহমুদা, মামলার বাদী ও সাহিনের মা আকলিমা এবং প্রত্যক্ষদর্শী শিশু মাশরাফি। তদন্তের স্বার্থে তাদের কাছ থেকে তথ্য নেন ডিবি কর্মকর্তারা। নিহতের স্বজন ও ডিবির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
সাহিনুদ্দিনের স্ত্রী মাহমুদা বলেন, আমরা দুপুর ২টায় ডিবি কার্যালয়ে যাই। আসরের পর সেখান থেকে বের হই। মামলার বাদী হিসাবে আমার শাশুড়ির সঙ্গে বেশি কথা বলেছেন ডিবি কর্মকর্তারা। তাছাড়া আমার ছেলে মাশরাফির সামনেই যেহেতু সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তাই প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তারও বক্তব্য নেওয়া হয়। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না বলে জানান তিনি।
সুমনের জবানবন্দির বরাত দিয়ে ডিবি সূত্র জানায়, জমিজমার দখলকে ঘিরে সাহিনুদ্দিনকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন সাবেক এমপি এমএ আউয়াল। আর লাশ চেয়েছিল সাবেক মেজর মোস্তফা কামাল।
২০০২ সালে সাহিনুদ্দিনের ভাই মাইনুদ্দিনের হাত ধরে পল্লবীর আলীনগরে আসেন আউয়াল। সেখানে হ্যাভেলি প্রপার্টিজের মাধ্যমে সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনসহ সাধারণ মানুষের জমি দখলের অপচেষ্টা চালায়। পরে সেখানে সাবেক মেজর মোস্তফা কামাল তিন কাঠা জমি কেনেন। এরপর মেজরও আশপাশের জমি দখলের চেষ্টা চালায়। এ নিয়ে আউয়াল ও মোস্তফার দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলছিল।
কিছুদিন আগেও সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনের অবস্থান ছিল মোস্তফার পক্ষে। সম্প্রতি সাহিনুদ্দিন চলে যায় আউয়ালের পক্ষে। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যেও দূরত্ব তৈরি হয়। জমিজমার বিরোধকে কেন্দ্র করে স্থানীয় এমপি ইলিয়াস মোল্লার মধ্যস্থতায় একাধিকবার বৈঠক হয়। মাস তিনেক আগে এমপির অফিসে একটি সমঝোতা বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে উভয় পক্ষ মেনে নিলেও পরে মেজরের কারণে সমঝোতা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি।
আলীনগরে সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনদের ৬২ শতাংশ এবং তাদের চাচা রবিউল এবং ফুপু বানেছার ২০ শতাংশ জমি আছে। সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনদের অভিযোগ, এ ৮২ শতাংশ জমি হ্যাভেলি প্রপার্টিজ লিমিটেড দখল করে নিয়েছে। এমপির মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ জমি মেপে সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনদের বুঝিয়ে দেবে হ্যাভেলি। পাশাপাশি তাদেরকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো জমি দখলকে কেন্দ্র করে অতীতে সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনদের বেশ কয়েকটি মামলা-হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে হ্যাভেলি। অপরটি হলো-হ্যাভেলি যখন প্রথম এই এলাকায় আসে, তখন সাহিনুদ্দিন-মাইনুদ্দিনদের কাছ থেকে নিজের নামে ২০ শতাংশ জমি লিখে নেয় হ্যাভেলি। ওই জমি আগেই সরকার অ্যাকোয়ার করেছিল। ওই জমি অ্যাকোয়ার অবমুক্ত করে দেওয়ার বিনিময়ে কিছু অংশ হ্যাভেলিকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আউয়াল ওই জমি অবমুক্ত করতে পারেননি। উপরন্তু সেই জমিতে প্লট বানিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন।
ডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সাহিনুদ্দিন হত্যার বিষয়ে আসামি সুমন ও টিটিুর কল রেকর্ডে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে কোন ধরনের তথ্য পেয়েছেন জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, মূলত জমিজমার দীর্ঘদিনের বিরোধের বিষয়টিই তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, সুমন ও তার সহযোগীরা আগে থেকেই আউয়ালের সহযোগী হিসাবে জমি দখলসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সম্প্রতি সাহিনুদ্দিন আউয়ালের গ্রুপে যোগ দেওয়ার পর তার ওপর বেশিমাত্রার নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আউয়াল। এতে সুমনের গুরত্ব কমে যায়। সম্প্রতি সুমন ও সাহিন একসঙ্গে আউয়ালের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সুমনের সামনেই আউয়াল বলেন, সাহিন ঠিক থাকলে আমার আর কাউকে লাগবে না। শুধু শুধুই সুমনদের পেছনে টাকা খরচ করব কেন।
এ কারণে সাহিনের প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয় সুমনের। এরই মধ্যে মোস্তফা একদিন সাহিনকে ডেকে আবেগপ্রবণ হয়ে বলে, ‘তোমার পেছনে আমি অনেক বিনিয়োগ করেছি। গত নভেম্বরে আউয়ালের নির্দেশে সুমন বাহিনী তোমাকে কুপিয়ে আহত করে, তখনও ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহায়তা করেছি। এখন কেন তুমি আউয়ালের পক্ষে গেলা?’
এতে সাহিনও কিছুটা অবেগপ্রবণ হয়ে বলে, ‘আমি একা আপনার পক্ষে থেকে কোনো লাভ হবে না। এতে আমি ক্ষতিগ্রস্তই হব। আপনি যদি সুমনকে ম্যানেজ করতে পারেন তাহলে আমি আবার আপনার পক্ষে কাজ করব।’ তখন সাহিনকে মোস্তফা বলেন, ‘তুমি সুমনকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করো।’ পরে সুমনকে নিয়ে সাহিন দেখা করে মোস্তফার সঙ্গে। এ বিষয়টি আউয়াল জেনে যায়। এরপরই সাহিনের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে আউয়াল। হ্যাভেলি প্রপার্টিজের কর্মকর্তা তাহের ও কিবরিয়াকে দিয়ে সুমনের হাতে তুলে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। বলা হয়, সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হাত-পা জখম করে দিতে হবে। তাহলে তার উচিত শিক্ষা হবে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তাহের ও কিবরিয়ার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর সুমন যোগাযোগ করে মোস্তফার সঙ্গে। তখন সাহিনকে শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় মোস্তফা। এছাড়া আউয়ালের কাছে সাহিনের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় সাহিনের ওপর তার ক্ষোভ ছিল। এসব কারণে উপর্যুপরি কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করা হয় সাহিনকে।
১৬ মে পল্লবীতে সাত বছরের শিশুসন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়ালকে। অন্য আসামিরা হলো সুমন বাহিনীর সুমন, আবু তাহের, মুরাদ, মানিক, শফিক, টিটু, রাজ্জাক, শফিক (২), কামরুল, কিবরিয়া, দিপু, মরণ আলী, লিটন, আবুল, ন্যাটা সুমন, কালু ওরফে কালা বাবু, বাবু ওরফে বাইট্যা বাবু ও বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু।
সাহিনুদ্দিন হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত দুইজন বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তারা হলো মনির হোসেন ও মানিক। এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ১০ জনকে। এদের মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি শেষে ইতোমধ্যে চারজন জেলহাজতে আছে। তারা হলো সুমন, মুরাদ, দিপু ও রকি। বাকি ছয়জন সাবেক এমপি আউয়াল, হাসান, বাবু ওরফে বাইট্যা বাবু, শরিফ, ইকবাল ও টিটু বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে রয়েছে।