আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় ৬ শতাংশ বাড়তে পারে



অর্থায়নের উৎসগুলো ঠিক মতো নির্ধারণ করতে না পারায় আগামী অর্থবছরে সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় আরও বাড়তে যাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, আগামী ২০২১-২২ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে ৬৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হতে পারে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ছয় শতাংশ বেশি।

এই অর্থের ৯২ শতাংশ খরচ হবে অভ্যন্তরীণ উৎস, যেমন: জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও স্থানীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য।

গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পুঞ্জিভূত পরিমাণ ছিল ৫৪০ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। এর ৫৮ শতাংশ নেওয়া হয়েছে উচ্চ-সুদের জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে।

সরকার প্রতিটি সঞ্চয়পত্রে গড়ে ১১ দশমিক তিন শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে আর অপরদিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চার শতাংশ হারে সুদ দেয়।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই জাতীয় সঞ্চয়পত্র বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে আরও অতিরিক্ত ৬৬ শতাংশ বেশি বিক্রি হয়।

সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো যদি অতিরিক্ত তারল্যের ওপর বসে থাকে, তাহলে কেন আমরা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ নিচ্ছি? এটি অপ্রয়োজনীয়।’

সরকার যদি ব্যাংকগুলোর কাছে যেত, তাহলে খুব সহজেই দুই থেকে তিন শতাংশ হারে তহবিল পেতে পারত। ব্যাংকগুলোর কাছে গত মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১৯৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য ছিল, যা গত বছরের তুলনায় ১২০ দশমিক সাত শতাংশ বেশি।

এ ছাড়াও, সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের কারণে সরকার দ্বিমুখী ক্ষতির শিকার হয়েছে। কারণ, সংগৃহীত অর্থের একটি অংশ এসেছে কালো টাকার উৎস থেকে।

একদিকে, কালো টাকার মালিকরা কর কম দেওয়ার সুযোগ নিতে পেরেছেন। অন্যদিকে, তারা বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর বেশি হারে সুদও পেতে যাচ্ছেন।

অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ ১৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছে এবং এর বড় অংশ এসেছে সঞ্চয়পত্র ও ফিক্সড ডিপোজিটে বিনিয়োগের মাধ্যমে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা খুব সহজেই আরও বেশি টাকা ঋণ নিতে পারতাম। সঙ্গে আমরা ঋণ ও এর সুদের টাকা আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারতাম।’

‘এ ক্ষেত্রে সরকারের বিদেশি সহায়তার অর্থ আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যেত’, যোগ করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সূচকগুলো নির্ধারিত সীমার নিচে রয়েছে এবং সরকারি ঋণের মাত্রা বেইজলাইন ও স্ট্রেস টেস্ট পরিস্থিতির আওতায় নির্ধারিত বেঞ্চমার্ক মানের নিচে রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৪৫ দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি থেকে সংগৃহীত তহবিলের ওপর সুদের হার যথাক্রমে এক দশমিক ২৫ শতাংশ, দুই শতাংশ ও এক শতাংশেরও কম।

এ ছাড়াও, প্রায় ৫০ দশমিক দুই বিলিয়ন বৈদেশিক সাহায্য পাইপলাইনে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। অপরদিকে, বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা মহামারি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেট সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

কম সুদের হারের সুবিধা নিয়ে উন্নত বিশ্ব থেকে বাংলাদেশে আরও বেশি পরিমাণ তহবিল আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে সঠিকভাবে তহবিল ব্যবহারে সরকারের অপারদর্শিতা।

ইআরডির সাবেক সচিব কাজী শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উদ্যোগের কারণে সরকারের বৈদেশিক তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সক্ষমতা বেড়েছে।’

বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের বাৎসরিক গড় হারটি ছয় বিলিয়ন ডলারের মতো থাকে। কিন্তু, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি সাত দশমিক তিন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, যা এ যাবত সর্বোচ্চ।

এর সঙ্গে আইএমএফের ৭৩৫ মিলিয়ন ডলারের নগদ অর্থ সহায়তাকে যুক্ত করলে এই পরিমাণটি আট বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

শফিকুল ইসলামের মতে, বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ার পেছনে সব সময় বাংলাদেশকে এককভাবে দায়ী করা উচিত নয়। উভয় পক্ষের কারণে এই প্রক্রিয়াটিতে দেরি হয়।

প্রকল্পের জন্য দাতাগোষ্ঠীর অনেক শর্ত থাকে, বিশেষ করে ক্রয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। এগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়।

‘তবে এই শর্তগুলো অনেক সময়ই অত্যাবশ্যক। কারণ, এর মাধ্যমে দুর্নীতি কমে যায়’, যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের দিক থেকে মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য বিভাগের অদক্ষতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়।

‘প্রকল্পগুলোও আবার বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়’, বলেন শফিকুল।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, সরকারকে দুর্বল আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি ঠিক করার জন্য সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। যাতে ব্যয়বহুল ঋণের উৎসগুলোকে আর ব্যবহার করতে না হয়।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের জিডিপিতে করের অবদান খুবই কম। এটি প্রায় আট শতাংশ। এটি আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

‘এই পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এমন সব আর্থিক সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়া, যেগুলো আমাদের ব্যয়বহুল ঋণের উৎসগুলোর ওপর নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনবে।’

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আখতার মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে উচ্চহারে সুদ পরিশোধ করতে বাধ্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে খরচ করার জন্যে সরকারের হাতে খুব কম পরিমাণ টাকা থাকছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেশি পরিমাণ ও বাড়তে থাকা সরকারি দেনার কারণে বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হয়। এর ফলশ্রুতিতে সরকারের ব্যয় ও রাজস্বের মধ্যে গড়মিল দেখা দেয়।’

সৈয়দ আখতার মাহমুদ মনে করেন, ‘এ কারণে সরকারের জন্যে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে আরও বেশি নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকারের বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জিডিপিতে করের অনুপাতটি কম থাকে। সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হয় যে, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ যেন দক্ষতার সঙ্গে খরচ করা হয়।’

Post a Comment

Previous Post Next Post