করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারা বিশ্বের শেয়ারবাজার ও আর্থিক খাতে ধস নেমেছে। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা কোনো বাছবিচার ছাড়াই তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। পতন ঠেকাতে শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে মহামারী কিংবা দুর্যোগের সময় বাজারে বড় পতন হলেও আতঙ্কিত না হয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পোর্টফোলিও পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন অভিজ্ঞ বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা।
করোনাভাইরাসের আগেও বেশকিছু বড় আকারের মহামারী পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মহামারীর প্রভাবে সেসময়ও আর্থিক খাত ও শেয়ারবাজারে ধস নেমেছিল। আবার মহামারীর প্রকোপ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মহামারী কিংবা দুর্যোগ কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। নির্দিষ্ট সময় পরই কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক বিনিয়োগকারীই তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা ভালো শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে দিয়েছেন। করোনার প্রকোপ কেটে গেলে বাজার যখন আবার ঘুরে দাঁড়াবে, তখন কিন্তু বিক্রি করে দেয়া শেয়ারের উত্থান দেখে অনেক বিনিয়োগকারীই আফসোস করবেন যে কেন বিক্রি করলাম? আবার একশ্রেণীর বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা বাজারের ক্রান্তিকালীন যখন সব কোম্পানির শেয়ার দরই উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়, তখন কম দামে ভালো ও গ্রোথ স্টক কিনে রাখেন। তাদের বিনিয়োগ দর্শনে স্বল্পমেয়াদে মুনাফা বলতে কিছুই নেই। তারা দীর্ঘমেয়াদে পোর্টফোলিওর সর্বোচ্চ রিটার্নে বিশ্বাসী।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড প্রাইভেট ব্যাংকের চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট স্টিভ ব্রাইস দুর্যোগকালীন বিনিয়োগের মূলনীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, এ সময় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরে চলার পাশাপাশি পোর্টফোলিও পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ছোট আকারের বিনিয়োগ করার পাশাপাশি পোর্টফোলিওতে যাতে ইকুইটি, বন্ড, নগদ ও স্বর্ণের মতো সব ধরনের সম্পদ থাকে।
সিঙ্গাপুরের বহুজাতিক ব্যাংক ডিবিএসের হেড অব ফিন্যান্সিয়াল প্লানিং লিটারেসি লরনা তান মনে করেন, দুর্যোগকালীন শেয়ারবাজারে প্রবেশ করার এবং নিজের ঝুঁকি বহন করার সক্ষমতা পরিমাপের ভালো সময়। তিনি আতঙ্কিত না হয়ে বিনিয়োগকারীদের চারটি মূলনীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন।
তানের মূলনীতিগুলো হচ্ছে—
দীর্ঘমেয়াদের জন্য বিনিয়োগ করুন: ন্যূনতম তিন থেকে ছয় মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা যাতে আপনার কাছে নগদ থাকে, সেটি নিশ্চিত করুন। কারণ আপনি জানেন না যে মহামারীর প্রকোপ দূর হতে কত সময় লাগবে। তাছাড়া এ সময়ে আপনি বাজারে বিনিয়োগ করলে, সেটি দীর্ঘসময়ের জন্য আটকে যেতে পারে তা মাথায় রাখতে হবে।
ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করুন: নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়মিতভাবে একই ধরনের পণ্যে (শেয়ার, বন্ড কিংবা ফান্ড যা-ই হোক) দীর্ঘসময় ধরে বিনিয়োগ করুন। এটি আপনাকে দাম কম থাকলে বেশি কেনা এবং দাম বেড়ে গেলে কম কেনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এটি ডলার কস্ট অ্যাভারেজ কৌশল হিসেবে পরিচিত।
চক্রবৃদ্ধি সুদের সুবিধা কাজে লাগান: শেয়ারবাজারে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুশৃঙ্খল বিনিয়োগ পরিকল্পনার মাধ্যমে সুদ আয় করুন।
বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্য এবং বৈচিত্র্য: যত বেশি সম্ভব নিজের পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনুন। কম দামে ইনডেক্স ফান্ড ও ইটিএফের মতো পণ্যে বিনিয়োগ করুন, যেগুলো পরোক্ষভাবে আপনাকে অনেকগুলো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেবে।
স্ট্যাশঅ্যাওয়ের চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার ফ্রেডি লিম শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিকে তরুণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো সুযোগ বলে মনে করছেন। ‘স্ট্যাশঅ্যাওয়ে ইনসাইট ২০২০’ অনুসারে বাজারের সংশোধন পর্বে এবং পতনের সময় যারা শেয়ার বিক্রি করেছেন কিংবা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাদের তুলনায় এ সময় যারা ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ভালো রিটার্ন পেয়েছেন।
ডিজিটাল ওয়েলথ ম্যানেজার সেফের সিইও ধ্রুব অরোরার মতে, বর্তমানে বাজারে যাদের বিনিয়োগ রয়েছে, বিক্রি না করে সেটি ধরে রাখতে হবে। বাজারের পাশাপাশি এটি ব্যক্তিবিশেষের জন্যও স্ট্রেস টেস্ট। আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন, যদি না আপনার নগদ অর্থের একান্ত প্রয়োজন হয়। আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আর্থিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারের নিম্নমুখিতা হয়তো আরো কয়েক মাস স্থায়ী হবে কিন্তু এর পরই বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ডিবিএসের লরনা তান অতীত ইতিহাসের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, প্রতিবারই বাজারকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক নির্দেশক যথেষ্ট শক্তিশালী—এ মতের প্রতি একমত পোষণ করে স্ট্যাশঅ্যাওয়ের ফ্রেডি লিম বলছেন, বর্তমান সংকটের কারণে প্রবৃদ্ধির গতি বিলম্বিত হতে পারে কিন্তু পথচ্যুত হবে না।
অবশ্য বিশ্লেষকরা ক্রান্তিকালীন ব্যবসার ধরনের কারণে কিছু কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে নির্ভরশীল, এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই শ্রেয়। এটি শুধু চীন নয় করোনাভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণে শিকার আরো যেসব দেশ যেমন ইতালি কিংবা স্পেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাছাড়া যেসব কোম্পানির অনেক বেশি ঋণ রয়েছে, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। দুর্যোগকালীন এসব কোম্পানির টিকে থাকার সক্ষমতা কম থাকে। তাছাড়া বাজারের ওঠা-নামার সঙ্গে যেসব কোম্পানির ব্যবসা বাড়ে-কমে, যেমন সম্পদ কিংবা মূলধনি সরঞ্জামের ব্যবসা করা কোম্পানি; সেগুলোতেও বিনিয়োগে বিরত থাকবে হবে।
অন্যদিকে এমন কিছু খাত রয়েছে, মহামারীর সময়ে যেগুলোর ব্যবসায় আরো প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হেলথ কেয়ার, বায়োটেকনোলজি ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। বৈশ্বিক মহামারীতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে ওষুধ। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হেলথকেয়ার ও বায়োটেকনোলজি কোম্পানিগুলো চেষ্টা করছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। যে কোম্পানি সবার আগে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করবে, স্বাভাবিকভাবেই সেটি ব্যবসায়িকভাবে এগিয়ে থাকবে। ফলে সেই কোম্পানির শেয়ারেরও ভালো চাহিদা থাকবে। তাছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিত্সায় যে কোম্পানির ওষুধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর, ব্যবসায়িকভাবে সে কোম্পানি এ সময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোও মহামারীর সময়ে ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি করে থাকে। কারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের কারণে পণ্য ও খাদ্য মজুদ করার প্রবণতা দেখা যায়।
শেয়ারবাজারে নিম্নমুখিতার পর ঊর্ধমুখিতা দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ উল্লেখ করে বলা সম্ভব নয় যে নিম্নমুখিতা কতদিন থাকবে। ফলে সুনির্দিষ্ট করে পতনের বৃত্তে থাকা বাজারে কখন বিনিয়োগ করার আদর্শ সময়, সেটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ একটি শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম কত হতে পারে, সেটি আপনি আগে থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। মন্দার কারণে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০০ টাকা থেকে কমে ৫০ টাকায় এসেছে, এটিকে আপনি সর্বনিম্ন দাম ধরবেন। হয়তো মন্দা আরো দীর্ঘস্থায়ী হলে শেয়ারটির দাম ২৫ টাকায়ও নেমে আসতে পারে। তখন আপনি ৫০ টাকায় শেয়ারটি কেনার জন্য আফসোস করতে পারেন। এ কারণেই বিশ্লেষকরা অল্প করে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন আপনি যদি ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে চান, সেক্ষেত্রে পুরো টাকাই একবারে বিনিয়োগ না করে আপনি ১০ হাজার টাকা করে ১০ ধাপে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে বেশি দামে শেয়ার কেনার সম্ভাবনা কমে যাবে এবং শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে আপনার যাচাই-বাছাই করার সুযোগ বেশি থাকবে। সবমিলিয়ে বাজারের গতিবিধি, আর্থিক খাতের গতিপ্রকৃতি ও মহামারী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি বিনিয়োগ গুরু ওরাকল অব ওমাহা ওয়ারেন বাফেট ইয়াহু ফিন্যান্সের কাছে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে করোনাভাইরাসের এ সময়ে বিনিয়োগকারীদের করণীয় কী হতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন। তার মতে প্রতিদিনের সংবাদ দেখে শেয়ার কেনা-বেচা করাটা ভালো কিছু নয়। এর মানে হচ্ছে করোনাভাইরাস আতঙ্কে সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির যে হিড়িক দেখা যাচ্ছে, সেটি বাফেটের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়।
সিএনবিসি, ইনভেস্টোপিডিয়া ও ইয়াহু ফিন্যান্স অবলম্বনে