আমরা কেউই মাতৃগর্ভ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আসি না। মা-বাবা সহ অনেকের যত্নে ৪-৫ বছর কাটার পর নিজেদের স্বাভাবিক চলা কিছুটা চলতে শিখি। পৃথিবীর কোন প্রাণী এর ব্যতিক্রম না (সময়ের ব্যাপারটা প্রাণীভেদে ভিন্ন) কিছুটা ভিন্নতা ছাড়া। একটা ঘুঘু পাখি যদি তার বাচ্চা ফোটার সাথে বাচ্চা ছেড়ে চলে আসে এবং বাচ্চার খবর না নেয় তাহলে ঐ বাচ্চা বাসাই মারা যাবে কিন্তু একটা কচ্ছপ সাগরতীরে ডিম পেরে চলে আসে, দেখা গেছে ডিম ফোটার পর মা কচ্ছপ ছাড়াই কচ্ছপ ছানা সাগরে পা নদীতে এসে স্বাভাবিক জীবন শুরু করে। ঘুঘুর বাচ্চা যে রকম মারা গিয়েছিল কচ্ছপের বাচ্চা সেরকম মারা যাওয়ার আশংকা খুবই কম। এরকম কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল প্রাণী অপত্যের যত্নের মাধ্যমে অপত্য বড় করে তোলে। ঘুঘু ও মাছরাঙ্গার মত এমনই তিনটি প্রাণীর অপত্যের যত্ন সম্পর্কে এই রচনা।
প্রখ্যাত আচরণ বিজ্ঞানী টিনবার্গেন তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাকের উপর গবেষণা করে প্রাণীর আচরনবিদ্যায় অনেক সফলতা এনে দিয়েছে। টিনবার্গেনের গবেষণার ভিত্তিতে স্টিকলব্যয়কের অপত্যের যত্ন:
এক থেকে তিন বছর বয়সে তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাক পরিণত (Mature) হয়। জননকাল ছাড়া অন্য সময় এরা ঝাঁকবদ্ধ হয়ে বাস করে। বসন্তকালে অর্থাৎ জননকালে পরিণত স্টিকলব্যাকেরা দলহীন হয়ে উপকূলবর্তী অগভীর পানির জলাশয়ে নিজস্ব বিচরণ পরিসীমা নির্ধারণ করে সতর্ক পাহারায় নিযুক্ত থাকে। কারও অনুপ্রবেশে হানাহানি না করে বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও বর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে ভয় দেখিয়ে তারিয়ে দেয়। বিচরণ সীমা প্রতিষ্ঠার পর সেখানে বাসা নির্মাণ শুরু করে। লক্ষণীয় যে বাসা নির্মাণে শুধু পুরুষ সদস্যই কাজ করে। বাসা নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গার তলদেশ থেকে মুখভর্তি বালু তুলে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার দূরে নিক্ষেপ করে। এভাবে একটি অগভীর গর্তের সৃষ্টি হলে পুরুষ মাছ সূত্রাকার শৈবাল ও অন্য জলজ উদ্ভিদ, নুড়ি ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ জড়ো করে বৃক্ক থেকে ক্ষরিত এক ধরনের প্রটিনজাত আঠালো পদার্থে আটকে দেয়। বাসার কাঠামো অবশ্যই স্ত্রী মাছের পছন্দ হতে হবে তা না হলে স্ত্রী মাছ ডিম পারতে আগ্রহী হয় না। যা হোক বাসাটি দুমুখ খোলা, মধ্যভাগ ফাঁকা ও সামান্য চওড়া ধরনের হয়ে থাকে।
বাসা নির্মাণ শেষ হলে পুরুষ মাছ উজ্জ্বল বর্ণ ধারন করে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় স্ত্রী মাছকে আকৃষ্ট করে বাসায় ঢুকিয়ে লেজটাকে ধাক্কা দিয়ে ডিম পারতে উদ্বুদ্ধ করে। ডিম পারা শেষ হলে পরুষ মাছ অতি দ্রুত ডিম গুলকে নিষিক্ত করে। একটা বাসায় দু-তিনটি
নীড় ও নীড়ের ভেতর থাকা নিষিক্ত ডিম গুলো থেকে সুস্থ পোনা উৎপাদন, রক্ষা, যত্ন নেওয়া ও সবশেষে নিরাপদ পরিবেশে ফিরে যাওয়া অনুকূলে রাখতে পুরুষ মাছ সদাব্যস্ত থাকে। ডিম ফোটার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য স্টিকলব্যাক এক অদ্ভুত আচরণ করে। বাসায় প্রবেশ পথের সামনে মাথা নিচু করে তীর্যকভাবে অবস্থান নিয়ে বক্ষ পাখনা সামনের দিকে সঞ্চালিচ করে অক্সিজেনের চাহিদা নিশ্চিত করে।
সাত আট দিনের মধ্য ডিম ফুটে পোনা বেরিয়ে আসে। পরুষ মাছটি পোনার দল অটুট রাখতে ব্যস্ত হয়ে পরে। দুসপ্তাহ পর পোনা দলবদ্ধ হয়ে নিজেরা চলতে পারে। এ পর্যায় অতিযত্ন ও সতর্কতার মাধ্যে রেখে বড় করে তোলা ভবিষ্যৎ বংশধর গুলকে ছেড়ে নিজের পূর্ণবয়স্ক ঝাঁকে ফিরে যায়।
অপত্য যত্ন প্রায় সব প্রাণিগোষ্ঠীতেই কম-বেশি দেখা যায়। উভচরীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় উভচরে এম যত্নের উদাহরণ একটু বেশি দেখা যায়। উভচর প্রাণীরা প্রথমে বাসা নির্মাণ করে এর পর ডিম পারা বা লার্ভা পরিবহনের মাধ্যমে যত্ন প্রক্রিয়া শুরু করে। গ্লেডিয়েট ব্যাঙ নামে পরিচিত দক্ষিণ আমেরিকার গেছো ব্যাঙের অপত্য যত্নর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
কাদা-মাটির নীড় নির্মাণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার উদ্দেশে বসতির আশেপাশে পুকুর, ডোবা বা এ ধরনের স্থায়ী জলার পাড়ে বাসা বানিয়ে ডিম পারতে ভালোবাসে
গ্লেডিয়েটর ব্যাঙ। জনন কালে পুরুষ ব্যাঙ এমন এক জায়গা বেছে নেয় যাতে গর্তখোঁড়া সহজ হয়, নির্মাণ কাজ রাতারাতি সম্পন্ন হয়। বাসা নির্মাণ, সে বাসা স্ত্রী ব্যাঙের পছন্দ হওয়া এবং নিরাপত্তা বিধান সবকিছু মাথায় রেখে স্ত্রী ব্যাঙ ডিম পারে। অতএব বাসা নির্মাণকে প্রাধান্য দিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় পরুষ ব্যাঙকে। গর্তকরে বাসা বানানোর কাজ শুধু পুরুষ ব্যাঙের কাজ।
পুরুষ ব্যাঙ গর্ত খুঁড়তে গিয়ে এমন ভাবে মাটি সরায় যাতে মাটি স্তুপাকারে পরে গেলে উঁচু কিনারার রূপ নেয়। গর্তের ব্যাস প্রায় ১২-৩৭২ সেন্টিমিটার, আর ৫-৭ সেন্টিমিটার গভীর। মাত্র তিরিশ মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাসা নির্মাণ সমাপ্ত হয়। বাসা নির্মাণ সমাপ্ত হলে পুরুষ ব্যাঙের ডাকে স্ত্রী ব্যাঙ সাড়া দিলেও বাসা ঘুরে ফিরে দেখে পছন্দ হলে তবেই ডিম পারে। ডিম ফুটে লার্ভা নির্গত হলে ওদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, নিরাপত্তা বজায় থাকে সব দিক বিবেচনা করে স্ত্রী ব্যাঙ সিদ্ধান্ত নেয়। ডিম ছাড়ার পর এলাকাভেদে পরুষ ব্যাঙ তার বংশ রক্ষায় তৎপর থাকে। পুরুষ ব্যাঙটি লার্ভা তরুণ ব্যাঙে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত গর্তের পাশে থেকে পাহারা দেয়। এভাবে চল্লিশ দিনের মধ্যে এদের রূপান্তর ঘটে।
আমরা জানি পাখি মাত্রই অপত্য যত্নে সমৃদ্ধ প্রাণী। এজন্যই আমি প্রথম থেকে ঘুঘু ও মাছরাঙ্গা পাখির উদাহরণ দেখিয়ে আসছি। সুস্পষ্ট ও সুসৃঙ্খল অপত্য যত্নে পাখি একটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রাণীগোষ্ঠী। ছোট পানকৌড়ি পাখির অপত্য যত্নর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
বাংলাদেশে পানকৌড়ির জননকাল মে-অক্টোবরে। তবে জুলাই-আগস্ট মাসে নীড় বাঁধার হার সবচেয়ে বেশি। এরা প্রধানতম আম ও বট গাছ, সঙ্গে কড়ই, শেওড়া গাছেও বাসা বাঁধে। পানির ধারে ও সহজে মানুষের হাতের নাগালে পাওয়া যায়না এমন উচ্চতায় (৬-১০ মিটার) বিভিন্ন গাছের খড়কুটা দিয়ে জোড়ের উভয় সদস্য বাসা বাঁধে। বাসার গড় ব্যাস প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার, গভীরতা প্রায় ৫.৫ সেন্টিমিটার।
পাঁচ থেকে এগার দিনের মধ্যে বাসা বাঁধা শেষ হলে পানকৌড়ি একদিন পরপর ২-৬ টি সাদা ডিম পাড়ে। তবে প্রথম ডিম পারার পর পরই ডিমে তা দিতে শুরু করে। স্ত্রী-পুরুষ উভয় তা দেওয়ার কাজ ভাগাভাগি করে নেয়। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে ডিম ফুটে সাবক বেরিয়ে আসে।
পানকৌড়ি শান্তশিষ্ট পাখি। দলবদ্ধ থাকায় শিকারি পাখির হামলা প্রতিরোধ সহজ হয়। কিন্তু দূরান্ত কিশোরদের মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না। ডিম ও সাবক নষ্ট হওয়ার কারন হচ্ছে খেলাচ্ছলে বা ঘরে পোষার জন্য সাবক চুরি, আর খাওয়ার জন্য ডিম চুরি। এছাড়া প্রচণ্ড ঝর-তুফানেও শাবকের ক্ষতি হয়। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে শাবকদের যত্ন নেয়ার কাজে স্ত্রী-পরুষ উভয় পাখি যথা সাধ্য সচেষ্ট থাকে। রাতে সার ক্ষন স্ত্রী পাখি বাসায় বসে থাকে ও পুরুষ পাখি বাসার আশেপাশে ডালে বসে পাহারায় থাকে। ১০-১৫ দিন পর্যন্ত পানকৌড়ি শাবকদের আগলে রাখে। এক মাসের মধ্যেই পানকৌড়ি শাবক নীড় ছেড়ে স্বাধীন জীবন যাপনে সক্ষম হয়ে ওঠে।
আশা করি, জলচর, উভচর ও খেচর প্রাণীদের অপত্য যত্ন সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পেয়েছেন এতখনে। স্থলচর প্রাণীর (মানুষ) অপত্য যত্ন আশা করি আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। আমরা সবাই মানুষ, সবাই স্থলচর। এই ব্যাপারে আমাদের সবার ভালো ধারনা আছে। কেন মা-বাবাকে এই দায়িত্ব নিতেই হয়? কেন নেয়? এই দায়িত্ব না নিলে হয়ত আজ আমার এই রচনা হত না, হতনা আপনার এই রচনা পড়া। মানুষ অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। শুধু মানুষ কেন সব প্রাণীর ক্ষেত্রে একথা সত্য। প্রাণীরা নিজ বংশীধর টিকিয়ে রাখার জন্যই এই লরাই করে আসছে। এই অপত্য যত্নের আচরণ কে বলা হয় সহজাত আচরণ। এটা জিনগত ভাবেই নির্ধারিত থাকে। সহজাত আচরণের জন্যই বাবুই পাখি এত সুন্দর বাসা বাধে, কোকিল কাকের বাসায় ডিম পারে। এসব কিছু বাবুই পাখি আর কোকিলের শিখার ফসল না বংশগত শক্তির বল অর্থাৎ সহজাত আচরণ।
তথ্যসংগ্রহ :
Gazi Azmal and Gazi Asmat – Biology 2nd Paper (Xi)
Wikipedia English
Wikipedia Bangla