সুহৃদ নিয়ে খেলছে কারা?

 


পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ারের দাম বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। বাড়লে শেয়ারের লেনদেন। কয়েক বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকা এই কোম্পানির শেয়ারের সাম্প্রতিক আচরণ বড় ধরনের কারসাজির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।


সোমবার (২৭ জুন) পুঁজিবাজারে আবর্জনাতুল্য (Junk) শেয়ার হিসেবে পরিচিত সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারে অনেক বড় লেনদেন হয়েছে। এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির ৩১ লাখ ২৭ হাজার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যার মূল্য ছিল ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্য দিয়ে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো কোম্পানিটি লেনদেনে শীর্ষ ২০ কোম্পানির তালিকায় জায়গা করে নেয়। আগের দিন তালিকার তৃতীয় অবস্থানে ছিল কোম্পানিটি। সোমবার অবশ্য অবস্থান কিছুটা পিছিয়ে ১৭তম স্থানে নেমে আসে।


সোমবার ডিএসইতে সর্বনিম্ন ২২ টাকা ৩০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২৩ টাকা ৪০ পয়সা দরে সুহৃদের শেয়ার কেনাবেচা হয়। শেয়ারটির ক্লোজিং মূল্য ছিল ২৩ টাকা ১০ পয়সা। আগের দিনের ক্লোজিং মূল্যের চেয়ে তা ৬০ পয়সা বা ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (Price Sensitive Information-PSI) গত এক মাসে শেয়ারটির দর বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ।


LankaBangla securites single page

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ নামের কোম্পানিটি অনেক দিন আগে থেকেই বাজার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুহৃদের অবস্থানে নেই। কোম্পানির উদ্যোক্তাদের বিরোধ, দখল-পাল্টা দখল, সীমাহীন লুটপাট, উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়া, খেলাপী ঋণের দায়ে কোম্পানির জায়গা-জমি ও কারখানা বিক্রির জন্য নিলাম আহ্বানসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে কোম্পানিটি বাজারের জন্য শত্রুতে পরিণত হয়েছে।


আর্থিক সঙ্গতি না থাকা সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে লভ্যাংশ ঘোষণার এবং ঘোষিত লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণ না করায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বছরের অক্টোবর মাসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়।


অন্যদিকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের জমি ও কারখানা ভবন নিলামে তোলার জন্য গত বছরের ২১ অক্টোবর নিলাম আহ্বান করেছিল বেসরকারি এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড। পরে অবশ্য কোম্পানিটি হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ এনে নিলাম ঠেকাতে সাময়িকভাবে সক্ষম হয়।


এমন একটি জালিয়াত কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক লেনদেন ও টানা মূল্য বৃদ্ধিতে ভয়ানক এক অশনিসঙ্কেত দেখছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কোনো ধরনের কারসাজি ছাড়া এভাবে শেয়ারের দাম ও লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি সম্ভব নয়। বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে এখনই কঠোর নজরদারিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।


উল্লেখ, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি বাজার থেকে ১৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তালিকাভুক্ত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই কোম্পানির পরিচালকরা কর্তৃত্ব ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। কোম্পানিটি দখল, পাল্টা-দখলের শিকার হয়। এক পর্যায়ে এর উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে।


কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং টানা লোকসান সত্ত্বেও উসৎ উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে আর্থিক বিবরণীতে মুনাফা দেখানো হয়। এতে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দেখানো হয় ১ টাকা ৩৮ পয়সা। ভুয়া মুনাফার বিপরীতে বছর শেষে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। কিন্তু দীর্ঘ পার হয়ে গেলেও সেই লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণ না করায় একাধিক বিনিয়োগকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করে। এর প্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি।


কেঁচো খোঁজার তদন্তে নেমে সাপ দেখে চমকে উঠে বিএসইসির তদন্ত কমিটি। তদন্তে উঠে আসে, লভ্যাংশ দেওয়ার মতো কোনো সঙ্গতি না থাকা সত্ত্বেও সুহৃদের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ অসৎ উদ্দেশ্যে ওই লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। তদন্ত রিপোর্টের আলোকে আনুষাঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করে বিএসইসি গত বছরের ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে লভ্যাংশ ঘোষণার সাথে সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়।


এদিকে চলতি বছরের ১০ মে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান কোম্পানির সাবেক পরিচালক জাহিদুল হক, মো. আনিছ আহমেদ এবং সাইয়েদা সাইমা আকতারের বিরুদ্ধে ১৯ কোটি টাকা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করে।

Post a Comment

Previous Post Next Post