প্রতিবেশী এক নারীর সঙ্গে বাবাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলাই ছিল কন্যাসন্তান ফাহিমার অপরাধ। পরে ফাহিমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনাই করেন ট্রাক্টরচালক বাবা আমির হোসেন। মেয়েকে চকলেট কিনে দেওয়া ও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে নির্জন জায়গায় নিয়ে যান। সেখানে হাত-পা বেঁধে ফাহিমাকে ছুরিকাঘাত করেন আমির হোসেনের চাচাতো ভাই রেজাউল। আর গলা চেপে শ্বাসরোধে ফাহিমার মৃত্যু নিশ্চিত করেন বাবা আমির হোসেন নিজে।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানিয়ে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শুধু তা-ই নয়, মৃত্যুর পর বাবা নিজেই মাইকিং করেন, বিভিন্ন স্থানে শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে নিখোঁজ মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করেন। এমনকি এ ঘটনায় থানায় মামলাও করেন অভিযুক্ত বাবা। তবে বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধারের পর ব্যবহৃত ফিডের বস্তার সূত্র ধরে আমির হোসেনসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হলেন- বাবা আমির হোসেন, চাচাতো চাচা রবিউল আউয়াল ও রেজাউল ইসলাম ইমন, পরকীয়া সম্পর্কে জড়িত মোসা. লাইলি আক্তার এবং সোহেল রানা। তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। র্যাবের দাবি, পার্শ্ববর্তী লাইলি আক্তার নামে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল আমির হোসেনের। ৫ নভেম্বর লাইলি ও আমির হোসেনকে শিশু ফাহিমা আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে এবং মাকে বলে দেওয়ার কথা জানায়। সেটিই যেন কাল হয় শিশুটির। লাইলি আক্তার ও আমির হোসেন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ বিষয়টি যেন কেউ জানতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমির হোসেনকে চাপ দিতে থাকেন লাইলি। তার প্ররোচনায় ৬ নভেম্বর ঘাতক আমির হোসেন গ্রেফতার অন্য সহযোগীদের নিয়ে শিশু ফাহিমা আক্তারকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করেন এবং লাইলি আক্তারকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি জানান। খন্দকার আল মঈন বলেন, শিশু ফাহিমাকে হত্যার পর স্ত্রীকেও খুন কিংবা ডিভোর্স দিয়ে লাইলিকে নিয়ে সংসার শুরু করতে চেয়েছিলেন আমির। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মেয়েকে হত্যা করা হয়।
যেভাবে হত্যা : প্রাথমিক জবানিতে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন ৭ নভেম্বর বিকালে কুমিল্লার দেবিদ্বারে পাঁচ বছরের শিশু ফাহিমা আক্তার নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় ফাহিমার বাবা আমির হোসেন দেবিদ্বার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। নিখোঁজের পর আমির হোসেন ৭ ও ৮ নভেম্বর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করেন। এমনকি ৮ নভেম্বর ঝাড়ফুঁক দিয়ে মেয়েকে খোঁজার জন্য একজন কবিরাজকেও খবর দেন। পরে ১৪ নভেম্বর পুলিশ কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর নজরুল মাস্টারের বাড়ির সামনে কালভার্টের নিচে সরকারি খালের ডোবা থেকে নিহতের বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করে। এরপর ফাহিমার পরিচয় নিশ্চিত করে তার পরিবার। ওই ঘটনায় আমির হোসেন বাদী হয়ে দেবিদ্বার থানায় মামলা করেন। নির্মম এ হত্যার ঘটনায় র্যাব-১১ ছায়াতদন্ত শুরু করে এবং রহস্য উদঘাটন ও জড়িত বাবাসহ পাঁচ আসামিকে গ্রেফতারে সমর্থ হয়।
র্যাব জানায়, পরিকল্পনা মোতাবেক ৬ নভেম্বর রাতে রেজাউল ইসলাম ইমনের ফার্নিচারের দোকানে আমির হোসেন টাকার বিনিময়ে রবিউল আউয়াল, রেজাউল ইসলাম ইমন ও সোহেল রানাকে সঙ্গে নিয়ে ফাহিমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ধারালো ছুরি ও হত্যার পর লাশটি লুকানোর জন্য দুটি প্লাস্টিকের বস্তা সংগ্রহ করেন তারা। পরে ৭ নভেম্বর বিকালে চকলেট কিনে দেওয়া ও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে চাঁপানগর রাস্তার মোড়ে সোহেল রানার সিএনজিতে করে দেবিদ্বার পুরান বাজারের দক্ষিণে নদীর নির্জন স্থানে শিশু ফাহিমাকে নিয়ে যান।
লাইলি আক্তারের উপস্থিতিতে আমির হোসেন মেয়ে ফাহিমার মুখ চেপে ধরে রাখেন এবং প্রথমে নিজেই মেয়েকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। রবিউল ভিকটিমের পায়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। রেজাউল ইসলাম ইমন ছুরি দিয়ে পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। সোহেল ছুরি দিয়ে ভিকটিমের পেছনে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করে দেন। পরে আমির হোসেন নিজেই ফাহিমার গলা চেপে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর শিশু ফাহিমার মরদেহ প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে সিএনজিতে করে ইমনের গরুর ঘরে ড্রামে লুকিয়ে রাখেন। ৯ নভেম্বর রাতে সোহেল রানার সিএনজিতে করে আমির হোসেন, রবিউল ও ইমন বস্তাবন্দী ফাহিমার মরদেহ দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর কালভার্টের নিচে ডোবায় ফেলে দেন।