দেশে নানা কারণে বাড়ছে স্ট্রোকের ঝুঁকি। বর্তমানে প্রতি হাজারে ১১ থেকে ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। স্ট্রোক করার সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে তিনি আবারো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। আশার কথা, স্ট্রোক করলেই এখন বিদেশ দৌড়াতে হচ্ছে না। সরকারি খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটিতে স্ট্রোকের পরপরই প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে কোনো টাকা লাগে না। সাথে থাকা-খাওয়া ও ওষুধ বিনামূল্যে দেয়। সবমিলে রোগী ভেদে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন স্বজনরা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে স্ট্রোকের চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম-পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেলাওয়ার হোসাইন দোলন।
ডক্টর টিভি: দেশে বর্তমানে কেমন সংখ্যক মানুষ স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন?
অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল: জনবহুল দেশের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। দেশে প্রতি হাজারে ১১ থেকে ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। এটি আরও তিন বছর আগের গবেষণা। উন্নত বিশ্বে এ হার ২-৩ শতাংশ। মূলত রোগীর এই অব্যাহত চাপের কথা চিন্তা করেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়।
ডক্টর টিভি: স্ট্রোকের চিকিৎসায় হাসপাতালটির সাফল্যের গল্প যদি একটু বলতেন…
অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল: প্রতিষ্ঠার গত নয় বছরে স্ট্রোক রোগীদের চিকিৎসায় শতভাগ বলব না, তবে আমাদের অর্জন কাঙ্ক্ষিত পথেই রয়েছে। বিশেষ করে স্ট্রোকের সর্বাধুনিক চিকিৎসার জন্য আগে যেখানে বিদেশ যেত হতো, এখন তা এখানেই করা সম্ভব হচ্ছে। তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে স্ট্রোকের রোগীকে হাসপাতালে আনা গেলে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। এজন্য তাকে একটি ইনজেকশন দিতে হয়, যার ব্যবস্থা আগে ছিল না। একটি জরুরি অস্ত্রোপচার, ক্লিপিং বা কয়েলিং, যা না করলে রোগী মারা যেতো। এখন আমরা এ অস্ত্রোপচার করতে পারছি।
ডক্টর টিভি: দেশেই স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বলুন…
অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল: ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি নামে একটি ডিপার্টমেন্ট আছে, যেখানে মাথার খুলি না কেটে স্ট্রোকের চিকিৎসায় রক্তনালীর মাধ্যমে আমরা ব্রেনে পৌঁছতে পারি। বিভিন্ন ধরনের স্ট্রোক হয়। এগুলো আগে থেকেই শনাক্ত করে আমরা ক্লিপিং, কয়েলিং দিতে পারি। এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য নিউরোসায়েন্স প্রায় শতভাগ দাবি করতে পারে। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে প্রথমে ধরা হয় ইসকেমিক স্ট্রোক, যেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এজন্য থ্রম্বোলাইসিস চিকিৎসা দিতে হয়। আমাদের এখানে এ চিকিৎসা ছাড়াও বর্তমানে ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগে রোগীরা সেবা নিতে পারছেন।
ডক্টর টিভি: কত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে আসলে রোগীকে শঙ্কামুক্ত বরা সম্ভব?
অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল: যে কোনো রোগী যদি তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে ইসকেমিক স্ট্রোক নিয়ে আসেন, তার সিটিস্ক্যান কারার পর উপযুক্ততা পেলে আমরা আইভি থ্রম্বোলাইসিস চিকিৎসা দিতে পারি। কোনো রোগীর থ্রম্বোলাইসিসে না হলে, বড় রক্তনালীর জমাট বেঁধে যাওয়া রক্ত অপসারণে একটি অস্ত্রোপচার করতে হয়, যেটাকে আমরা বলি থ্রোম্বেক্টমি। সেটিও আমাদের এখানে রয়েছে। আমরা খুব শিগগির তা চালু করতে পারব। আবার কোনো রোগীর বড় একটি রক্তনালী ছিড়ে গেছে, রক্তক্ষরণে অজ্ঞান হয়ে গেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে সে রক্ত বের করে দিতে হয়, এই চিকিৎসার সুযোগও এখানে রয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে যেনো আর স্ট্রোক না হয়, সেজন্য জন্মগতভাবে রক্তনালীতে কোনো ত্রুটি পেলে তা আমরা ব্লক করতে পারি। এতক্ষণ যেগুলোর কথা বললাম, কোনো রোগী এসবের একটির মধ্যেও না পড়লে তাকে আমরা কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিয়ে থাকি। মোদ্দা কথা, স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসার জন্য সারা বিশ্বে যত পদ্ধতি বর্তমান, সবগুলোই আমাদের এখানে রয়েছে।
ডক্টর টিভি: দেশের স্ট্রোক চিকিৎসার অগ্রগতিতে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন…
অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল: উন্নত দেশের সাথে আমরা তুলনা করতে চাই না। কারণ আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চাইলেই সব রোগী আমরা ভর্তি নিতে পারি না। আমাদের শয্যার সংকুলান নেই। আবার শুধুমাত্র নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল দিয়ে সার্বিক সাফল্য কিংবা স্ট্রোকের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করা সম্ভব হবে, এমনটি আশা করা ঠিক না। তবে চিকিৎসা তুলনা করলে আমরা আধুনিক চিকিৎসা দিচ্ছি। পরিস্থিতির আরও পরিবর্তনে আমাদের লোকবল বাড়ানো, তাদের মানসম্মতভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে থ্রম্বোকটমি যেটি রক্তনালীর ভেতর থেকে জমাট রক্ত বের করে নিয়ে আসে এটা নিয়মিত করা জরুরী। তবে এক্ষেত্রে আমাদের লোকবল খুব কম। ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজির বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আছে, ইদানিং ঢাকা মেডিকেল শুরু করেছে। এটি সারা দেশে ছড়ানোর জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এটি করতে পারলে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হবে।
ডক্টর টিভি: নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে স্ট্রোকের চিকিৎসার খরচের বিষয়ে যদি কিছু বলতেন…
অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম মন্ডল: স্ট্রোকের কনজারভেটিভ চিকিৎসা তেমন ব্যয়বহুল নয়। কিন্তু ব্রেনের মধ্যে রক্তনালীতে কোনো এনোরিজম থাকলে দুটি চিকিৎসা রয়েছে। একটা হলো, কয়েলিং ও ক্লিপিং। কয়েলিংয়ের ক্ষেত্রে কয়েলগুলো কিনতে হয়। তবে আমরা খুব শিগগির কয়েল সরবরাহ করতে পারব। হার্টের চেয়ে ব্রেনের কয়েলের দাম বেশি। একজন রোগীর চার-পাঁচটি কয়েল লাগে। একটি কয়েলের দাম ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ রোগীর ৪-৫ লাখ টাকা লেগে যায়। ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে আমরা যে ব্রেনের কয়েলিং করি, এটি ব্যয়বহুল। তবে মাথার খুলি কেটে ক্লিপিং করতে খরচ তেমন হয় না। এখানে অস্ত্রোপচারে কোনো খরচ নেই। সব মিলিয়ে ক্লিপিং ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো হয়ে যায়। রোগী অপরাগতা প্রকাশ করলে আমরা তাকে খুলি কেটে চিকিৎসা দেই। সত্যি বলতে, এখানে সরকারি শয্যার খরচ নেই। থাকা-খাওয়া ও ওষুধপত্র বিনামূল্যে দেওয়া হয়। বলা চলে নামমাত্র খরচে চিকিৎসা নিয়ে রোগী বাড়ি চলে যেতে পারেন।
তবে স্ট্রোকের চিকিৎসার সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে প্রান্তিক অঞ্চলের মেডিকেল কলেজে একটি করে স্ট্রোক ইউনিট করতে হবে। পঞ্চগড়ের রোগী যেন সেখানেই দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এতদিনের অভিজ্ঞতা হলো, স্ট্রোকের সব রোগীকে ঢাকায় আনার দরকার নেই। সরকার চাইলে প্রান্তিক মেডিকেলেই আমরা তার সব চিকিৎসা দিতে পারব। এ ধরনের চিকিৎসক আমাদের রয়েছে।
সুত্রঃ ডক্টর টিভি