বাড়ছে রাত, বাড়ছে ভয়; কোন দিকে যাচ্ছে ঝড়!!




কালো মেঘের মধ্যে পূর্ণিমার চাঁদ মিটিমিটি আলো ছড়াচ্ছে। পশুর নদে জোয়ার আসতে শুরু করছে। দমকা বাতাসে ফুঁসে উঠছে ঢেউ। শব্দ করে সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। দোকানদার জাহাঙ্গীরের ব্যস্ততাও বেড়েছে। দোকান থেকে মালপত্র দ্রুততার সঙ্গে সরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। মোংলা বন্দরের বিপরীত তীরের বাণীশান্তা বাজারঘাটে জাহাঙ্গীরের দোকান। একবারে পশুর নদ লাগোয়া।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে কাজের ফাঁকে জাহাঙ্গীর বলছিলেন, আকাশের পরিস্থিতি ভালো না। জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুফানের গতিও বাড়ছে। যেকোনো সময় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটতে পারে। দিনে হলে তো কোনো এক জায়গায় সরে যাওয়া যায়। রাতে হলে তো কিছু করার থাকে না।আম্পানের দুঃস্বপ্ন এখনো তাড়া করে জাহাঙ্গীরকে। সে সময়ও তাঁর দোকান ভেসে গিয়েছিল। ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে বললেন, একবার মালপত্র নষ্ট হলে তো কোনো সহায়তাও মেলে না।


জাহাঙ্গীরের দোকানের পশ্চিম পাশে হরিদাশ রায়ের দোকান। ৩৫ বছর ধরে বাণীশান্তা বাজারে ব্যবসা করছেন। দোকানের মেঝেতে বসে নিবিষ্টমনে উচ্চ শব্দে রেডিওতে খবর শুনছিলেন। আলাপে আলাপে জানালেন, কয়েক দফায় তাঁদের ঘরবাড়ি ঝড়ে তছনছ হয়েছে। এখন আর দুর্যোগে অতটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন না। বললেন, ‘খবর শুনে বুঝলাম, খুব অসুবিধা হবে না। যদি বুঝতাম দুবলার চর বা খুলনার দিকে আসছে, তাহলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতাম।’


উপকূলীয় দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা বাজার নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা বন্দরের বিপরীত তীরের এই বাজার বেশ জমজমাটও। বাজারে দোকানে দোকানে ঝড় নিয়ে আলোচনা। একটি দোকানের জনাবিশেক লোকের এক আলোচনায় যোগ দিয়ে ওই এলাকার মানুষের দুর্ভাবনা নিয়ে নানা কথা জানা গেল।


মোংলা-বাণীশান্তা যন্ত্রচালিত মাঝি-মাল্লা সমিতির সদস্য মো. আনোয়ার হাওলাদার বলছিলেন, ‘ঝড় তো প্রায় বছরই আসছে। শঙ্কা করে লাভ কী? তবে ঝড়ের রাতে সারা রাত বসেই কাটাব। আজ ৯টার দিকে জোয়ার ভালোভাবে চলবে। এরপর থাকবে ছয় ঘণ্টা, তাহলে রাতের বাকি থাকবেটা কী।’ তিনি আরও বলেন, একটু আগে ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার বলেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে। কিন্তু এত বড় এলাকায় একটা আশ্রয়কেন্দ্র। কত লোক আর যাবে। গেলে ভীষণ কষ্ট হয়।পাশে থাকা একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, ‘এলাকায় বাঁধ হয়েছে। তবে তা মানসম্পন্ন হয়নি। কিন্তু আমরা কারে বলব। রাস্তার ভেতরে দেওয়া হয়েছে বালু। এসব তো দেখার কথা জনপ্রতিনিধিদের। তাঁরা তো মাল খাইয়ে চুপ। আমরা কিছু বলতে গেলে আবার মামলা-হামলার হুমকি।’ উপস্থিত জনতার প্রায় সবাই তাঁর কথায় সায় দিলেন।


সেখানে বসা আবদুল হক নামের এক ব্যক্তি বললেন, ‘দুর্যোগে সব সময় যুদ্ধ করতে হয়। আজ দুপুরে জোয়ারে বারান্দায় পানি উঠে গিয়েছিল। পানি যা বাড়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেড়েছে। ঝড় এলেই আমরা ঢাংমারী–রেখামারীর লোক হাড়ে হাড়ে টের পাই। রাতে কী হবে জানি না। পানি যদি বেশি হয়, তাহলে খাটের ওপর উঠে থাকতে হবে। যদি আরও বেশি হয় তবে নৌকা আছে ঘাটে। নৌকার ওপর বসে রাত কাটাতে হবে।’ সনজিত মণ্ডল বলেন, এই এলাকার লোক কেউ ভিটে ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। তবে রাতে প্রায় মানুষ ঘুমাবে না। দুর্যোগের রাতে মানুষ ঘুমাতে পারে না।ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পাশাপাশি বাজারে বিভিন্ন দোকানে অন্য একটি আলোচনাও জোরেশোরে চলছিল। যেটা হচ্ছে গলদা-বাগদার রেণুর দাম পড়ে যাওয়া। পশুর নদে রেণু সংগ্রহ করে ওই এলাকার অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত দুই দিনে রেণুর দাম পড়তির দিকে। কারণটা অবশ্য ইয়াস।

রেণুর ব্যবসায়ী সুপ্রভাত মণ্ডল বলছিলেন, এক দিন আগেও গলদা রেণু ২ হাজার ৬০০ টাকা ছিল আজ ১ হাজার ৮০০ টাকা প্রতি হাজার। বাগদা রেণু ছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা এখন ১ হাজারে। এ বছর নদীতে পোনা নেই বললেও চলে। গত দুই দিন পোনা পড়ছে। এখন দামও পড়ে গেল।

পোনা ব্যবসায়ীরা জানান, বাণীশান্তা বাজারে প্রতিদিন আনুমানিক ৩০ হাজার পোনা কেনাবেচা হয়। নারী–পুরুষ নদীতে জাল টেনে তা সংগ্রহ করেন। সেসব রেণু রামপাল, মোংলা, ফকিরহাট, বাগেরহাট, ডুমুরিয়া—এসব এলাকার ঘেরমালিকেরা কেনেন। ইয়াসের কারণে পানির চাপ বাড়ছে, ভয়ে ঘেরমালিকেরা মাছ নিতে চাচ্ছেন না। আবহাওয়া খারাপ। পোনা সংগ্রহকারী নারীদের মন খারাপ। পোনা পড়া শুরু হলো। দাম নেই।

প্রশান্ত সরদার বলেন, ‘আজ হাজারে মাত্র ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা লাভ হয়েছে। অন্য দিন বেশি হয়। ঘেরমালিকেরা পোনা নিতে চাচ্ছেন না, যদি না নেন, কিনে কী করব। পোনা তো আর মজুত করে রাখা যায় না।কাল আবার অনেকে নামবে পোনা ধরতে, অনেকে নামবে না, মাছও কম হবে।’

আলাপের ফাঁকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আর আসেনি। এদিকে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post