সূচক ৭ হাজার পয়েন্টে ছোঁয়ার প্রত্যাশায় ৫ কারণ

 





 


ঈদুল ফিতর পরবর্তী দেশের শেয়ারবাজারে বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারে লেনদেন ছাড়িয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। বাজার মূলধন বেড়েছে ২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। সূচক ৬ হাজার পয়েন্ট ছুঁই ছু্ঁই। আর বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। শেয়ারবাজারে এ উত্থানকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন অনেকেই। বাজারের এমন স্থিতিশীল আচরণের পেছনে ৫টি ইতিবাচক যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সামনে দিনে শেয়ারবাজার আরও গতিশীল ও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন সূচক ৬ হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে ৭ হাজার পয়েন্টের মাইলফলক অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


সংশ্লিষ্টদের চোখে শেয়ারবাজার ইতিবাচক থাকার ৫টি কারণ হলো-আসন্ন প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজাটে করপোরেট কর কমানোর আভাস, বর্তমানে ব্যাংকগুলো আয় ভালো অবস্থানে রয়েছে ও ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে, ব্যাংকের শেয়ার এখনও অনেক কম দাম পাওয়া যাচ্ছে, বিমা কোম্পানিগুলোর আয়ও অনেক বেড়েছে ও ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে এবং শেয়ারবাজারের প্রাইস আর্নিং রেশিও (পিই) অন্যান্য দেশের তুলনায় কম রয়েছে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইক্স ৬ হাজার পয়েন্টের কাছাকাছি আসলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক ভীতি কাজ করে। অনেকেই ভাবতে শুরু করে, এ পরিস্থিতিতে বাজার আর বাড়বে না। বাজার কারেকশন হয়ে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে চলে আসবে। তবে শেয়ারবাজারের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এটা না হলো শেয়ারবাজারের পরিসর বাড়ানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলছেন, বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে। আর বেশির ভাগ বিনিয়োগ আসছে পুরোনো বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে। বর্তমান ইতিবাচক পরিস্থিতির কারণে অনেক নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এছাড়া লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুম হওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বেড়েছে ব্যাংকের বিনিয়োগও। যার ইতিবাচক প্রভাবে বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে।


এছাড়া, এবার ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করলেই বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থা আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইক্স চালু হয় ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। ওই ডিএসইএক্স ছিল ৪০৫৫ পয়েন্টে। এরপর টানা ৪ বছরের বেশি সময় পর ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল ডিএসইএক্স সূচক সর্বোচ্চ ৫৭৭৭ পয়েন্টে উঠে। তারপর সূচকটি পুনরায় নেমে আসে। পরবর্তী সময়ে ওই বছরের ৩১ আগস্ট প্রথমবারের মতো ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজারের মাইলফলক অতিক্রম করে ইতিহাস গড়ে। ওইদিন ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬০০৬ পয়েন্টে। এরপর থেকে টানা ছয় মাস অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূচক ৬ হাজার পয়েন্টে অবস্থান করে। ওইদিন ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ৫০ পয়েন্টে। এরপর থেকে সূচক পুনরায় ধারাবাহিকভাবেই কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ২০২০ সালের ৮ জুন ডিএসইএক্স সূচক কমে ৩ হাজার ৯৫৬ পয়েন্টে চলে আসে। তবে ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক আর ৬ হাজার পয়েন্ট স্পর্শ করেনি। তবে এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ৬ হাজার পয়েন্টের কাছাকাছি অবস্থানে এসেও সূচক ফিরে যেতে লক্ষ্য করা গেছে। ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজারের কাছাকাছি অর্থাৎ ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্ট উঠে।


শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। বড় বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় ও ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ায় বাজার চাঙা হচ্ছে। শেয়ারবাজারের বর্তমান ইতিবাচক পরিস্থিতির কারণে অনেক নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হচ্ছেন।


বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি সায়েদুর রহমান বলেন, আসন্ন বাজেট আরও শেয়ারবাজারবান্ধব হতে পারে বলে ইতোমধ্যে আভাস পাওয়া গেছে। বাজেটে কিছু ভালো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর ইনকাম ভালো রয়েছে। ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ব্যাংকের শেয়ার এখনও অনেক লো প্রাইসে পাওয়া যাচ্ছে।


এদিকে বিমা কোম্পানিগুলোর আয় অনেক বেড়েছে ও ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। পিই রেশিও অন্যান্য দেশের তুলনায় কম রয়েছে। এছাড়া করোনা সংকট কাটিয়ে উঠার পর বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার আশঙ্কাজনকভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় আমাদের শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে এবং আরও ভালো হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে সূচক নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক ভীতি কাটিয়ে উঠলেই শেয়ারবাজার আরও গতি ফিরে পাবে।


প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ ফজলে রাব্বী বলেন, আশা করছি মার্কেট আরও ভালো হবে। বড় হবে এবং মার্কেটের ক্যাপাসিটি আরও বাড়বে। যে কারণে বিএসইসি নতুন করে ট্রেক অনুমোদন দিয়েছে। সামনে আরও দেবে। এছাড়া ব্রোকারেজ হাউজগুলো নতুন নতুন ব্রাঞ্চ ও ডিজিটাল বুথ খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ শেয়ারবাজারের পরিসর বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদি সবকিছু সঠিক নেতৃত্বে ও সঠিক দিক নির্দেশনায় আগায়, তাহলে সূচক কোনো ব্যাপার না। সূচক ৬ হাজার উঠলেই মার্কেট পড়ে যায়- এটা আসলে বিনিয়োগকারীদের একটা মনস্তাত্ত্বিক ভীতি। গত এক-দেড় বছর আগেও মার্কেটে সঠিক দিক নির্দেশনা ছিল না যা ৬ হাজার সূচক অতিক্রম করতে পারে। এখন মার্কেটের সেই গতি নিয়ে আগাচ্ছে। আমি মনে করি সূচক ৬-৭ হাজার বড় কথা নয়, ডিমান্ড থাকলে মার্কেট বাড়বে।


বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিএসইসির চেয়ারম্যানের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি, অর্থমন্ত্রীর সহযোগিতা, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিবেচনায় শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে নতুন ইতিহাস গড়বে।

Post a Comment

Previous Post Next Post