পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩ কোম্পানির দর কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। কোম্পনিগুলো হলো- আরামিট সিমেন্ট, ইজেনারেশন এবং ইনডেক্স এগ্রো। এর মধ্যে ইজেনারেশন এবং ইনডেক্স এগ্রো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নতুন কোম্পানি। তালিকাভুক্তির পর গত কার্যদিবসে সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়েছে। অপরদিকে, আরামিট সিমেন্ট লোকসানী কোম্পানি। ঝুঁকিপূর্ণ পিই রেশিও সত্বেও ধারাবিহকভাবে কোম্পানিটির দর বাড়ছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আরামিট সিমেন্ট: আলোচিত ৩ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে আরামিট সিমেন্ট। বর্তমানে কোম্পানিটির পুঁঞ্জিভুত লোকসানের পরিমাণ ৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন যথাক্রমে- ৫০ কোটি টাকা ও ৩৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কোম্পনিটি সর্বশেষ ২০১৬ সালে ১২ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। এরপর আর কোনো ডিভিডেন্ড দেয়নি। কোম্পািনটির মূলধনের তুলনায় পুঁঞ্জিভুত লোকসানের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে গেলেও বিনিয়োগকারীদের পুঁজি ফেরত দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এরপরও কোম্পানিটির শেয়ার দর ৩১ টাকা।
গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর ২ টাকা ৮০ পয়সা বা ৯.৬৯ শতাশ বেড়ে সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমায় অবস্থান করেছে, যা দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এদিন কোম্পানিটির লেনদেন শুরু হয় ২৮ টাকা ৯০ পয়সায়। ২০ মে কোম্পানিটির সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ৩১ টাকা ৭০ পয়সায়, যা গত গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দর। গত ১৮ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র ৩ কার্যদিবস দর কমেছে। গত ৩ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৪ টাকা ১০ পয়সা। গত বছর আগস্ট মাসে ৪ তারিখে কোম্পানিটি শেয়ার দর ছিল ১১ টাকা ৮০ পয়সা। ১০ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। যেখানে ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর তলানীতে নেমে আসায় বিনিয়োগকারীরা লোকসানের কবলে পরেছে। সেখানে এমন একটি দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে মুনাফা করে পুঁজি ফেরত পাওয়া যাবে তার কি নিশ্চয়তা আছে?
এদিকে, কোম্পানিটি চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে লোকসান দেখিয়েছে এক টাকা ৩২ পয়সা। কিন্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকে কিভাবে লোকসান কাটিয়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) এক টাকা ৯ পয়সা দেখিয়েছে। কোম্পানিটির দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই অস্বাভাবিক হারে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে যা সন্দেহজনক মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানিটি দর বাড়ানোর উদ্দেশেই কৃত্রিমভাবে মুনাফা দেখিয়ে থাকতে পারে। যদি এটা সঠিকভাবে দতন্ত করা হয় তবে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।
পিই রেশিও বিহিন ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানিটির ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৪৭.১৪ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, ১৪.৭৮ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ৩৮.০৮ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে।
ইনডেক্স এগ্রো: গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে শতাংশের হিসেবে দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে বিবিধ খাতের নতুন কোম্পানি ইনডেক্স এগ্রো। এদিন কোম্পানিটির দর ৫ টাকা ৬০ পয়সা বা ৬.৭৮ শতাংশ বেড়ে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৮৮ টাকা ২০ পয়সায়, যা তালিকাভুক্তির পর সর্বোচ্চ। এদিন এ কোম্পানির শেয়ারের সর্বোচ্চ দর ছিল ৯০ টাকা ৮০ পয়সা। এদিন লেনদেন শুরু হয় ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দিয়ে।
গত ১১ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির দর বেড়েছে প্রায় ২৮ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির দর কমেছে ২ কার্যদিবস।
গত ৭ এপ্রিল উভয় পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির লেনদেন শুরু হয় ৭৫ টাকা দিয়ে। ওইদিন লেনদেনের প্রথম এক ঘন্টা পর্যন্ত কোম্পানিটির প্রায় ১৭ হাজারের বেশি শেয়ার ১৫২ বারে হাত বদল হয়েছে। কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন ৭৫ টাকায় শুরু হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম দিন কোম্পানিটির শেয়ার দর সর্বোচ্চ সীমা ২৫ টাকা বা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। আইপিওতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০ টাকা করে। লেনদেন শুরুর প্রথম তিন কার্যদিবসেই দর কমে দাঁড়িয়েছিল ৫৮ টাকা ৮০ পয়সায়। ১৩ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কোম্পানিটির দর ৬০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬২ পয়সা ৪০ পয়সায় ওঠানামা করে, যা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ৪ মে’র পর থেকেই কারণ ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে দর বাড়ছে। এরপরও অদৃশ্য কারণে কোম্পানিটিকে শোকজ করা হয়নি।
কোম্পানিটি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৮২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪৯টি শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। এর মধ্যে ৪৩ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৪টি শেয়ার প্রতিটি ৫০ টাকা মূল্যে (প্রান্ত সীমা থেকে ২০ শতাংশ বাট্টায়) ইস্যুর মাধ্যমে ২১ কোটি ৮০ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলন করেছে।
আর বাকি ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫টি শেয়ার কাট-অফ প্রাইসে অর্থাৎ ৬২ টাকা করে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছে ইস্যুর মাধ্যমে ২৪ কোটি ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৩০ টাকা উত্তোলন করেছে।
শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলিত অর্থ দিয়ে কোম্পানিটি ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ক্রয় এবং আইপিও খরচ খাতে ব্যয় করবে।
কোম্পানিটির ৩০ জুন ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী পুন:মূল্যায়ন সঞ্চিতিসহ নীট সম্পদ মূল্য ৪৫.০৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে এবং বিগত ৫ বছরের অর্থবছরের ভারিত গড় হারে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৭.০৭ টাকা। কোম্পানিটির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড এবং ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট।
ইজেনারেশন: অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলছে তথ্য প্রযুক্তি খাতের নতুন কোম্পানি ইজেনারেশনের দর। ধারাবাহিকভাবে দর বেড়ে কোম্পানিটির শেয়ার দর তিন মাসের মধ্যে প্রায় ৪ গুণ বেড়েছে। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির দর এক টাকা ৮০ পয়সা বা ৩.২২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ টাকা ৭০ পয়সা। এদিন কোম্পানিটির সর্বশেষ দর ছিল ৬১ টাকা ৩০ পয়সা। লেনদেন শুরু হয়েছিল ৫৫ টাকা ৯০ পযসা দিয়ে। র্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দর সম্পদমূল্যের দ্বিগুণের বেশি।
কারণ ছাড়াই কোম্পানিটির শেয়ার দর অস্বাভাবিভাবে বাড়লেও ডিএসইর পক্ষ থেকে একবার তদন্ত নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এরপরও থেমে নেই কোম্পানিটির শেয়ার দর। গত ৯ কার্যদিবসের মধ্যে কোম্পানিটির দর বেড়েছে ১৬ টাকারও বেশি। অথচ গত বছরের তুলনায় কোম্পানিটির আয় কমেছে।
চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ’২১) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৪৬ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৫৪ পয়সা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় আয় কমেছে ৮ পয়সা বা ১৪.৮১ শতাংশ।
তিন প্রান্তিক মিলিয়ে তথা ৯ মাসে (জুলাই’২০-মার্চ’২১) কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা ২৫ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে ১ টাকা ৫৮ পয়সা ছিল। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় আয় কমেছে ৩৩ পয়সা বা ২০.৮৮ শতাংশ।
২৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ১৫ টাকা দিয়ে। এদিন মাত্র ২০১টি শেয়ার মাত্র ২বার হাতবদল হয়, যার বাজারমূল্য ৩ হাজার টাকা। এরপর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ার দর কমার তুলনায় ধারাবাহিকভাবে শুধু বেড়েই চলেছে। অথচ কোম্পানিটি গত বছরের তুলনায় আয় কমেছে।
যখন কোনো কোম্পানির আয় কমে তখন সে কোম্পানির শেয়ার দরে এর প্রভাব পড়ার কথা। কিন্ত কোম্পানিটির বেলায় উল্টো দর বাড়ছে। এর পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানিটি নতুন হওয়ায় এর উপর খুব বেশি নির্ভর করা ঠিক হবে না। কারণ ইতিমধ্যে কোম্পানিটির মুনাফা কমে গেছে। এরপর জুন ক্লোজিংয়ে কোম্পানিটির মুনাফা কমে যাওয়ায় নামে মাত্র ডিভিডেন্ড দিতে পারে। বাজারে ভালো ভালো অনেক কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর দর সে হারে না বেড়ে এরকম একটা নতুন কোম্পানির দর অস্বাভাবিক হারে বাড়াটা সন্দেহজনক। বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে এ শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে আরো বেশি সতর্ক হওয়া। কোম্পানিটির শেয়ার দর যে আবার তলানিতে আসবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে। বর্তমান দরে কেউ এ শেয়ারে বিনিয়োগ করলে পরবর্তীতে এর তলানীতে নেমে আসলে তার মুনাফা হওয়া দূরের কথা পুঁজি ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, কোম্পানিটি অভিহিত মূল্যে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। যা দিয়ে ডিজিটাল প্লাটফরম সল্যুশন, নতুন বাজার উন্নয়ন, আইওটি-ভিত্তিক সল্যুশন এবং আইপিও খরচ পরিচালনা করা হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ৮২ পয়সা। আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) রয়েছে ২০ টাকা ৫৬ পয়সা।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (২০ মে) কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৫৫ টাকা ৯০ পয়সায়। এদিন লেনদেন শুরু হয়েছিল ৫১ টাকা দিয়ে। লেনদেন ৪৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৫৬ টাকা ১০ পয়সায় উঠানামা করে। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৪ টাকা ৯০ পয়সা বা ৯.৬১ শতাংশ, যা সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা।
বর্তমানে কোম্পানিটির অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন যথাক্রমে- ১০০ কোটি টাকা ও ৭৫ কোটি টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির রিজার্ভের পরিমাণ ৫৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। এ কোম্পানির ৭ কোটি ৫০ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩৭.৭৭ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, ৩০.৮৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ০.৪৫ শতাংশ বিদেশি এবং ৩০.৯৪ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে।