"কাউকে না কাউকে ঝুঁকি নিতে হবে" পদোন্নতি না পাওয়া সারওয়ার আলম ।


বি'শেষ প্রয়ো'জনে রা'ত ১২টার দিকে ফোন করে'ছিলাম ম্যা'জিস্ট্রেট সা'রওয়ার আলমকে। তখন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হচ্ছে। ফোন ধরে বললেন, ‘ভাইয়া অভিযানে আছি, খুব জরুরি না হলে শেষ করে কথা বলি।’ সেই রাতে আর কথা হয়নি। কারণ, রাতভর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।


কয়েক'দিন পর উত্তরা'য় র‌্যাবে'র প্র'ধান কার্যা'লয়ে দেখা। একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে খেতে জিজ্ঞেস প্রশ্ন করলাম, এত বড় বড় মানুষদের বিরুদ্ধে অভিযান করছেন, ভবিষ্যত ক্যারিয়ারে এর প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে কিনা? প্রশ্ন শুনে বেশ হাসিমুখেই উত্তর দিলেন, কাউকে না কাউকে ঝুঁকি নিতে হবে। চাকরি করি প্রজাতন্ত্রের। জনগণের জন্য কাজ করি। সরকার যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটাই করছি। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হতে পারে, এই ভেবে তো বসে থাকা যাবে না।


বসে থাকতে না চাইলেও সারওয়ার আলমকে বসিয়ে রাখার আয়োজন কম হয়নি। উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে রিট পিটিশনও করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, শিশুদের দণ্ড দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সারওয়ার আলমকে আটকানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে বদলি করা হলো। একইভাবে বদলি করা হয়েছিল নিরাপদ খাদ্য নিয়ে যুদ্ধ করা আরেক জনপ্রিয় কর্মকর্তা মাহবুব কবির মিলনকে। সরকারের জনপ্রিয় এই দুই কর্মকর্তার বদলির ক্ষেত্রে এক ধরনের কৌশল নেয়া হয়েছিল বলে মনে হয়। মাহবুব কবির মিলনকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে রেলওয়েতে পাঠানো হয় গত বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে। তখন করোনা নিয়ে দেশে হইচই অবস্থা। মিডিয়া, সরকার, জনগণ সবাই ব্যস্ত করোনা নিয়ে। এমন সময় তাকে বদলি করা হয়। যেন তার বদলির বিষয়টি আলোচনায় না আসে।

সারওয়ার আলমকে বদলি করা হয়েছে গত বছরের নভেম্বরের ৯ তারিখে। ওই দিন সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান হত্যার প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবরকে গ্রেফতার করা হয়। মিডিয়া ও জনগণের নজর ছিল সেদিকেই। ফলে সারওয়ারের বদলিও আলোচনা এড়িয়ে যায়।

ব্যতিক্রম ঘটেছিল ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের ক্ষেত্রে। ২০১৯ সালের ৩ জুন তাকে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর থেকে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। তখন অন্য কোনো গরম ইস্যু ছিল না। ফলে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। মানুষ বিক্ষোভ করে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তাকে স্বপদে বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়। মঞ্জুর শাহরিয়ারকে বদলির আদেশের পর সেই আদেশ বাতিল করা বোধ হয় কারো কারো জন্য অস্বস্তিকর হয়। সম্ভবত এই বদলিকারীরা সেখান থেকেই শিক্ষা নেয়।

জনপ্রিয় কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষেত্রে তারা কৌশলী হয়। যে কৌশল পরবর্তীতে মাহবুব কবির মিলন ও সারওয়ার আলমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সফল হওয়া গেছে। যখন দেশে কোনো ইস্যু নিয়ে তুমুল হইচই চলবে তখনই এসব কর্মকর্তাদের সরাতে হবে। নিরবে স্বার্থ হাসিল হয়ে যাবে।

এসব ব্যক্তিদের আবার সরিয়ে ক্ষ্যান্ত হন না কর্তারা। তাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থাও চলতে থাকে। মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিষয়টি তিনি প্রকাশ করেননি। মাহবুব কবির মিলনের দুর্নীতি বিরোধী এক বক্তব্যের জন্য বিভাগীয় অভিযোগ এনে তাকে তিরস্কার করা হয়েছে। আর সারওয়ার আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বয়ং আদালতে ঝুলছে।

অথচ বিদেশে টাকা পাচার করা পুলিশ কর্মকর্তাকে সেরা কর্মকর্তার পুরস্কার দেওয়ার খবর আমরা দেখি। শত কোটি, হাজার কোটি টাকা লুট করেও দিব্যি সমাজে বুক ফুলিয়ে চলা মানুষদের আমরা প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি হতে দেখি। অবস্থা দেখে মনে করা যায়, যে যত বড় চোর সে তত ক্ষমতাবান, তত সম্মানিত, তত নিষ্পাপ। আর যে হিরোরা দেশের জন্য, জনগণের জন্য কাজ করে তারা হয়ে যায় ভিলেন।

দেশে চোরদের পুরস্কৃত করা আর নায়কদের তিরস্কার করার দৃষ্টান্ত নতুন নয়। এই দৃষ্টান্তগুলো সারওয়ার আলম জানতেন না এমনও নয়। কিন্তু দেশের প্রতি, চাকরির প্রতি ও জনগণের প্রতি দার দায়বদ্ধতা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। বহু ঝুঁকি নিয়েছেন। শুধু ক্যাসিনো নয়, সারওয়ার আলমের কার্যক্রমের ফিরিস্তি লিখলে বড় বড় বই লেখা যাবে। একটা একটা অভিযানের ঘটনা দিয়ে একটা একটা সিনেমা তৈরি করা যাবে। তাঁর অনেক অভিযান বলিউড-হলিউডের সিনেমার সঙ্গে তুলনা করা যায়। শতাধিক বড় বড় অভিযান করেছেন তিনি। ছোট ছোট অভিযান ছিল তার দৈনন্দিন রুটিন।

এর প্রতিদান কী পেলেন সারওয়ার আলম? যা পেলেন তা তাঁর ভাষায়, ‘চাকরি জীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন তাদের বেশির ভাগই চাকরি জীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটাই অন্যায়!’ অনবরত মানুষের জন্য কাজ করতে থাকা একজন কর্মকর্তাকে যখন এভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়, তখন এর কোনো প্রতিকার প্রত্যাশা করা অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়।

সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতিতে বাদ পড়েছেন সারওয়ার আলম। খবরে বলা হয়েছে, ‘পদোন্নতির ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য ছিল বিসিএসের ২৭তম ব্যাচ। এ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের ২৪০ জনকে (ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া কর্মকর্তাসহ) পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু তিন শতাধিক সফল অভিযানের ট্যাগ লাগানো র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলমের পদোন্নতি মেলেনি। পদোন্নতি পাওয়া ৩৫৮ কর্মকর্তার মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ২৭৮ জন রয়েছেন। তাদের (২৭৮ জন) মধ্যে ২৭তম ব্যাচের ২৪০ জন (ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া কর্মকর্তাসহ) আছেন। বাকি ৩৮ জন অন্যান্য ব্যাচের। এছাড়া অন্যান্য ক্যাডার থেকে মোট পদোন্নতি পেয়েছেন ৮০ কর্মকর্তা।

বিসিএস ২৭তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে ২০০৮ সালের নভেম্বরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন সারওয়ার আলম। ২০১৪ সালের ১ জুন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। সে অনুযায়ী এ পদে প্রায় সাত বছরসহ মোট ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি, যা পদোন্নতির শর্ত পূরণ করে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় অভিযোগ নেই। বরং নানা সাহসী অভিযানের কারণে বিভিন্ন সময় প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই কর্মকর্তা। তবুও তার পদোন্নতি না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন অনেকে। একইসঙ্গে কেন পদোন্নতি পাননি, সে প্রশ্নও উঠেছে।’

তার পদোন্নতি না পাওয়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আনিছুর রহমান মিঞা বলেছেন, ‘আমার জানা মতে যারা যোগ্য তারা সকলেই পদোন্নতি পেয়েছেন। বাকিদের বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার আমার নেই। কারণ পদোন্নতি আমরা দেই না। পদোন্নতি দেওয়ার জন্য যে বোর্ড (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) আছে, তারা সবকিছু বিশ্লেষণ করে যারা যোগ্য তাদের পদোন্নতি দিয়েছে বলেই আমি জানি।’

অর্থাৎ এই সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের বিবেচনায় সারওয়ার আলম যোগ্য ব্যক্তি নন। যাদের পদোন্নতি হয়েছে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু ২৭তম ব্যাচের প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা সততা ও কাজ দিয়ে দেশবাসীর ভালোবাসা পেয়েছেন তার মধ্যে সারওয়ার আলম অবশ্যই সবার শীর্ষে। সবার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিটি যখন অযোগ্য বিবেচিত হয় তখন সাধারণ মানুষের মনে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড নিয়ে প্রশ্ন জাগে।

সেই প্রশ্ন থেকেই স্বনামধন্য সংবাদকর্মী শরিফুল হাসান লিখেছেন,  কী বার্তা আসলো গেল? আপনি ঘুষ খান-দুর্নীতি করেন, তাতে পার পেয়ে যেতে পারেন কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে বললেই জুটবে তিরস্কার।  সিন্ডিকেট ভাঙতে চান পদে পদে বিপদে পড়বেন। এসবের মধ্যে দিয়ে আসলে কী বার্তা যায়? একজন কর্মকর্তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে কেন তাকে তিরস্কৃত হতে হবে? কেন সততার সঙ্গে কাজ করার পরেও পদোন্নতি হবে না? এভাবে চললে ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ? রাষ্ট্র ও নীতি নির্ধারকেদের কাছে অনুরোধ, সৎ ও যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কৃত করুন। মূল্যায়ণ করুন। তাদের কাজের সুযোগ দিন। ভালো কাজের মূল্যায়ন না হলে ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার আগ্রহ হারাতে পারেন অনেকে। আর এমন প্রশ্নও তখন উঠবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা কী অন্যায়!

২৭ তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারে সারওয়ার আলমের নাম সবার উপরে থাকার পরেও তিনি অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন সুপিরিয়র কমিটির কাছে। কিন্তু জনগণের কাছে সারওয়ার আলম অযোগ্য নন। তিনি দেশপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তা। তিনি আমাদের কাছে হিরো। হিরোদের পদপদবী, সম্পদ বা স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না। হিরোরা মানুষের হৃদয়ে বসবাস করে। তাই সারওয়ার আলম যেখানেই থাক, তিনি আমাদের কাছে থাকবেন হিরো হিসেবে।

লেখক: সিফাত শাহরিয়ার প্রিয়ান, শিক্ষার্থী -জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post