মহাবিশ্ব সৃষ্টি : বিগ ব্যাং
আলীম আল রাজী
এই মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হলো? প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তা করেছেন অনেক বড় বড় দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এরিস্টেটল মনে করতেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব সর্বদাই এমন ছিলো। সে আরও মনে করতো, সূর্য ও নক্ষত্রগুলো এক জটিল কক্ষপথে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।পরবর্তীতে নিউটন গ্যালিলিওরা এরিস্টটলের পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব থেকে বের হয়ে সূর্য কেন্দ্রিক সৌরজগতের সন্ধান দিতে পারলেও, স্থির মহাবিশ্বর ধারণা থেকে বের হয়ে কিছু বলতে পারেনি।
নিউটনের বলেছিলেন, আমাদের মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো একে অপরকে টেনে ধরে আছে। সমান শক্তির দুজন লোক একটি দড়ির দুইপাশ থেকে টানলে যেমন মনে হবে দড়িটির উপর কোন বল প্রয়োগ করা হচ্ছেনা। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা এমনই। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা হচ্ছে, নক্ষত্রগুলো কিন্তু ঠিকই তাদের একটি কেন্দ্র ধরে নিয়ে কোন এক যায়গায় পুঞ্জিভুত হয়ে যাবে। এই সমস্যার সমাধান করলেন তিনি অসীম ভিত্তিক মহাবিশ্বের কল্পনা এনে। তিনি বললেন, যেহেতু আমাদের মহাবিশ্ব অসীম, তাই এর নির্দিষ্ট কোন কেন্দ্র নেই। ফলে নক্ষত্রগুলিও পারছেনা কোন এক বিন্দুকে কেন্দ্র ধরে তার মধ্যে পুঞ্জিভুত হতে।
লুডভিক বোলজম্যান তার তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে বলেছিলেন, মহাবিশ্বের সকল কিছুই প্রতিনিয়ত বিশৃংখলার দিকে এগোচ্ছে। তার এই তত্ত্ব যদি সত্য হয়, তবে আমাদের এই মহাবিশ্বেরও প্রতিনিয়ত বিশৃংখলার দিকে আগানোর কথা। তখন মহাবিশ্বের স্থিতি মডেল নিয়ে বিজ্ঞানীদের টনক নড়লো। কারন, সময়ের সাথে যদি মহাবিশ্বের বিশৃংখলা বেড়ে যায়, তাহলে অসীম সময় ধরে একটি মহাবিশ্ব একই অবস্থায় থাকতে পারেনা।
জর্জ লেমেত্রি ১৯২৭ সালে প্রথম দাবি করেন, মহাবিশ্ব স্থির নয়। এটি সময়ের সাথে সাথে চারদিকে প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দুইভাগ হয়ে গেলেন। একভাগ গেলো স্থির মহাবিশ্বের পক্ষে, আরেকভাগ প্রসারনশীল মহাবিশ্বের পক্ষে। আইন্সটাইন নিজেও প্রসারনশীল মহাবিশ্বকে খুব ভালো চোখে দেখেননি। ১৯১৬ সালে তার সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করার পর তার সূত্র থেকেই তিনি বলতে পারতেন আমাদের এই মহাবিশ্ব প্রসারণশীল। কিন্তু জোর করে একটি ধ্রুবক বসিয়ে মহাবিশ্বকে তিনি স্থির হিসেবেই প্রকাশ করার চেষ্টা করলেন। তিনি একটি মহাকর্ষ বিরোধী বল এই সমীকরনে জোর করে যুক্ত করেছিলেন, যাতে পুরো মহাবিশ্বটি প্রসারিত বা সংকুচিত না হয়ে ঠিক ঠিক স্থিরভাবে বসে থাকে।
১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান দুটি স্বীকার্যকে ধরে এবং আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা ব্যাবহার করে বললেন, আপেক্ষিকতা সত্য হলে মহাবিশ্বকে অবশ্যই প্রসারনশীল হতে হবে। স্বীকার্য দুটি হলো,
> ১. আমরা যেদিকে তাকাই না কেন মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে।
> ২. যদি মহাবিশ্বকে অন্য কোন যায়গা হতে পর্যবেক্ষন করি, তবুও মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? আইন্সটাইন সকল বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু হাবলের একটি পরীক্ষার পর তাকে বলতেই হলো যে মহাবিশ্বকে স্থির ধরা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। হাবল পৃথিবী থেকে বিভিন্ন নক্ষত্রের দূরে সরে যাওয়া বা কাছে আসার হার নির্ণয় করতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি দেখলেন, গ্যালাক্সীগুলো আমাদের থেকে প্রতিনিয়ত দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব যদি স্থির হতো, তাহলে দূরে সরে যাওয়া গ্যালাক্সী ও কাছে আসা গ্যালাক্সীর সংখ্যা সমান হতো।
তিনি এই হিসাবটি করেছিলেন ডপলার এফেক্ট ব্যবহার করে। বিজ্ঞানী ডপলার এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি দেখতে পেলেন কোন বস্তু যদি পর্যবেক্ষকের দিকে আসে, তবে বস্তুটি হতে নির্গত শব্দ তুলনামুলক চিকন হয়ে যায়। আর যখন দূরে সরে যেতে থাকে তখন হয়ে যায় মোটা। অথবা পর্যবেক্ষক যদি শব্দ উতপন্যকারী বস্তু হতে দূরে সরে যেতে থাকে, তাহলে শব্দ চিকন ও কাছে আসতে থাকলে শব্দ মোটা শোনা যাবে। চিকন শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট ও মোটা শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হয় বড়। এ থেকে বুঝা যায়, কোন শব্দ উৎসের সাথে পর্যবেক্ষকের দূরত্ব যখন সময়ের সাথে হ্রাস পায়, তখন পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হয় তরঙ্গদৈর্ঘ্য চিকন হয়ে গেছে এবং এর বিপরীত ও সমানভাবে সত্য। এটা বুঝতে হলে আমাদের একটু চিন্তা করতে হবে তরঙ্গ নিয়ে। ধরি, একটি উৎস থেকে একটি তরঙ্গ বের হচ্ছে। যেটি প্রতি একটি তরঙ্গ সম্পন্ন করার সাথে সাথে একটি করে টিক শব্দ করছে। এখন আপনি কোন এক যায়গায় দাড়িয়ে সেই তরঙ্গটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ণয়ের চেষ্টা করছেন। যখন আপনি এবং উৎস উভয়ই স্থির, তখন কোন সমস্যা না হলেও সমস্যা দেখা যাবে যখন আপনি অথবা উৎস যে কোন দিকে গতিশীল হবে। যদি আপনি উৎসের দিকে বা উৎস আপনার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, তাহলে একটি টিক আপনার কাছে আসতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম সময় লাগবে। কারন প্রতি মূহুর্তে আপনাদের মধ্যে দুরত্ব কমছে এবং সেই কম দূরত্ব অতিক্রম করতে তরঙ্গটিরও সময় লাগছে তুলনামূলক কম। ফলে মনে হবে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। আবার ঠিক উলটা ব্যাপার ঘটবে যখন দেখা যাবে, আপনি ও তরঙ্গটি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তখন মনে হবে তরঙ্গটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়েছে। কারন তখন আপনার কাছে একটি টিক শব্দ আসতে আগের চেয়ে বেশী সময় লাগবে। পরবর্তীতে চিন্তা করা হলো, একই ব্যাপার তো আলোর ক্ষেত্রেও ঘটা স্বাভাবিক। যখন আলো আমাদের দিকে আসবে তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মনে হবে কম এবং যখন দূরে সরে যাবে, তখন মনে হবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। আর আলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তরঙ্গ হলো লাল আলোর তরঙ্গ। এজন্য আলোর উৎস যখন দূরে সরে যায়, তখন উৎসের আলোকে তুলনামূলক বেশী লাল দেখায় এবং উৎস পর্যবেক্ষকের দিকে আসলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী নীল লাগে। হাবল যখন তার টেলিস্কোপ দিয়ে দূরের গ্যালাক্সীগুলো দেখছিলো, তখন সকল গ্যালাক্সীকেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী লাল দেখাচ্ছিলো। তার মানে সকল গ্যালাক্সী আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।
এবার এক কাজ করি। মহাবিশ্বে গ্যালাক্সীদের গতিপথের ভিডিও চিত্রকে উলটা পথে চালাই। যেহেতু গ্যালাক্সীগুলো পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে, ভিডিওকে উল্টাদিকে চালালে নিশ্চয় গ্যালাক্সীগুলো পরস্পর কাছে আসতে থাকবে। এবং এমন এক সময় আসবে যখন মহাবিশ্বের সকল পদার্থ একে অপরের সাথে লেগে যাবে। তারমানে দাড়াচ্ছে এই যে, আমাদের মহাবিশ্ব এখন যেমন সর্বদা তেমন ছিলোনা। একটা সময় ছিলো, যখন মহাবিশ্বের সবকিছু একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভুত ছিলো। তাহলে তো খুবই ভালো। কেন্দ্রিভুত যখন ছিলো, তখন একসাথে থাকতেই বা কি সমস্যা? কেনই বা এখন সকল গ্যালাক্সীর মধ্যে এমন মনঃমালিন্য? বিজ্ঞানীরা চিন্তা করে বললেন, আসলে তখন এতোকিছু এতো ক্ষুদ্র যায়গায় ছিলো যে, মহাকর্ষ বল আর তাদের আকর্ষন করে ধরে রাখতে পারেনি। পদার্থগুলো একে অপরকে এতো জোরে ধাক্কা মারলো যে, সেই ধাক্কার রেশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে গ্যালাক্সীগুলো।
বিগব্যাং নামটির পিছনের গল্পও কিন্তু যথেষ্ট মজাদার। ১৯৪৯ সালে বিবিসির একটি সাক্ষাতকারে তিনি এই তত্ত্বকে তাচ্ছিল্য করে বিগব্যাং (বৃহৎ শব্দ) নামে ডাকেন। পরে সেই নাম এতোটাই বিখ্যাত হলো যে, এই তত্ত্বের নামই হয়ে গেলো বিগব্যাং থিওরী।
আরেকটি তথ্য এখানেই দিয়ে রাখি। কোন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানিকে ভুলেও প্রশ্ন করতে যাবেন না বিগব্যাং এর আগে কি ছিলো? তাহলে তারা কিন্তু খুব রেগে যায়। বিজ্ঞানীদের মতে বিগব্যাং এর মাধ্যমেই স্থান ও কালের সূত্রপাত। এর আগে কোন স্থান বা কাল ছিলোনা। এই প্রশ্নটি অনেকটা উত্তর মেরুর উত্তরে উত্তরে কি আছে সেটা খোজার মতো ব্যাপার।